নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা সেরে ওঠার পরও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতা : পোস্ট কভিড সিনড্রোম

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
করোনা সেরে ওঠার পরও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতা : পোস্ট কভিড সিনড্রোম

ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা : গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বে কভিডের নতুন করে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ প্রাদুর্ভাবের কারণ ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়েন্ট জেএন.১। অথচ চার বছর পুরনো অনেক রোগীও এখন পর্যন্ত পোস্ট কভিড জটিলতায় (করোনা-পরবর্তী জটিলতা) ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যারা কভিড আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৫০-৭০ শতাংশ রোগী তিন-ছয় মাস পর্যন্ত কভিড-পরবর্তী নানা জটিলতায় ভুগেছেন। কিছু উপসর্গ থেকে গেছে দীর্ঘকালীন। কভিড আক্রান্ত করেছে ফুসফুস, লিভার, স্নায়ুতন্ত্রকে যার রেশ থেকে গেছে অনেক দিন। আসুন জেনে নেয়া যাক কী কী জটিলতা হয়েছে বা হতে পারে:

পোস্ট ভাইরাল এসথেনিয়া বা পোস্ট ভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম: করোনা-পরবর্তী সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পোস্ট ভাইরাল ফ্যাটিগ। শারীরিকভাবে প্রচণ্ড দুর্বল লাগা, অবসাদ বা ক্লান্তিবোধ হওয়া, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, হাত-পা অবশ ভাব, ঝিঁঝি লাগা, মাংসপেশি, হাড় বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, কোমরে ও মেরুদণ্ডে ব্যথা, অরুচি, অস্থিরতা এগুলো প্রায় অনেকদিন ধরে থাকছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের।

পরিপাকতন্ত্র: কভিড-পরবর্তী যেসব রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলজিস্টদের গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগেরই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা তৈরি হয়েছে। গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে মুখ, গলা, পাকস্থলী, ছোট ও বড় অন্ত্র, মলদ্বার এবং সেই সঙ্গে লিভার ও অগ্ন্যাশয়। এগুলোর কাজ এনজাইম তৈরি করে হজমে সাহায্য করা। এগুলো ঠিকভাবে কাজ না করায় হচ্ছে আলসার। নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, লিভারের আলসারের ঝুঁকি রয়েছে ৬২ শতাংশ, অ্যাসিড রিফ্লাক্স রোগের ঝুঁকি ৩৫ শতাংশ আর ভয়ংকর প্যানক্রিয়াটিসের ঝুঁকি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

ফুসফুস: করোনাভাইরাস ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়া রোগ ডিপিএলডি করেছে অনেকের ক্ষেত্রেই। ফলে ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট, শুকনা কাশি হচ্ছে অনেকেরই। পাশাপাশি অ্যাজমা, সিজনাল ফ্লু, নিউমোনিয়ায় সহজেই সংক্রমিত হচ্ছে বারবার। এর কারণ হিসেবে দায়ী পরিবর্তিত রোগ প্রতিরোধক্ষমতা।

স্নায়ুতন্ত্র: চিকিৎসকরা বলেছেন, অনেক সময় করোনা আক্রান্ত রোগীর মাথা ঘোরা, তীব্র মাথাব্যথা, সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিভ্রম বা ভুলে যাওয়ার প্রবণতার মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এমনকি রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে ব্রেইন স্ট্রোকের ঘটনাও ঘটছে। এসব রোগের ফলে অজ্ঞান হওয়া, শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের দুর্বলতা বা প্যারালাইসিস ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

হরমোনজনিত রোগ ও ডায়াবেটিস: করোনা-পরবর্তী অসুস্থতা নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নিতে হচ্ছে অনেকের, বিশেষ করে যারা আগে অ্যান্টি ডায়াবেটিস মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, তাদের ক্ষেত্রে এ চিত্র বেশি।

মানসিক স্বাস্থ্য: করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার পর কারো কারো মানসিক অবসাদ, মনঃসংযোগে সমস্যা হচ্ছে। মানসিক অসুস্থতার ধরন জানতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশ রোগীর করোনা সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ ছিল। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাইরাসটিতে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্বেগ ও বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতায় ভোগা মানুষের হার ছিল প্রায় ১১ শতাংশ।

হৃদরোগ: যাদের আগে থেকেই হৃদরোগ ছিল, তাদের রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়, এমনকি মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে। আর যাদের হৃদরোগ ছিল না তাদের মায়োকারডাইটিস, কার্ডিওমায়োপ্যাথি হতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি রোগে (ক্রনিক ডিজিজ) আক্রান্ত রোগী: যেসব রোগীর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভার, স্ট্রোক ও হার্টের সমস্যা রয়েছে করোনা তাদের বিপদ বাড়াচ্ছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় যারা কেমো বা রেডিওথেরাপি নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে এটা ভয়ংকর হতে পারে।

করণীয়

করোনা থেকে মুক্ত হলেও এক বছর নিয়মিত চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হবে। নিয়মিত সুষম খাবার খেতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ডায়েট ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন, জেনে নেবেন আপনার জন্য কোন ধরনের ডায়েট উপযুক্ত। যাদের আগে থেকে বিভিন্ন রোগ ছিল, তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে খাবার গ্রহণ করবেন। জানতে হবে খাবার ও ওষুধ, আবার খাবারও অনেক রোগ তৈরি করে। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম যেমন হাঁটা ও চলাফেরা, বয়সভেদে কায়িক পরিশ্রম, অ্যারোবিকস ব্যায়াম করতে হবে।

ফুসফুসের ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী। জোরে শ্বাস নিয়ে ৩-৬ সেকেন্ড ধরে মুখ দিয়ে ছেড়ে দেয়া, এভাবে ছয়-সাতবার করে দৈনিক দুই-তিন বেলা করা যাবে। গাছপালাবেষ্টিত উন্মুক্ত স্থানে হাঁটা ও ব্যায়াম শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে কার্যকর। হাড়জোড়া, মাংসপেশির ক্ষয় ও ব্যথা রোধে ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন চিকিৎসা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ ও ইলেকট্রোথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর।

বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট ও ভিটামিন যেমন ভিটামিন-ডি, ই, এ, মাল্টিভিটামিন, জিংক, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, গ্লুকোসামাইন, কনড্রোটিন সালফেট, কোলাজেন করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা ও জটিলতা কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। তবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণ করতে হবে।- ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ

শেয়ার করুন