নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

দ্য ব্রঙ্কসে কবির সঙ্গে মধ্য যামিনী ডিনার

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০৬:১২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০৬:১২ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
দ্য ব্রঙ্কসে কবির সঙ্গে মধ্য যামিনী ডিনার

কদিন আগে লিখেছিলাম অনেক আকাশ উড়ে বার্লিন এখন নিউ ইয়র্কে। অর্থাৎ বার্লিন প্রবাসী কবি ও লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারির কথা বলেছিলাম। ‘বার্লিনকন্যা’ নিউ ইয়র্কে আসেন ফিবছর।

নিউ ইয়র্কের সঙ্গে তার সম্পর্ক অন্বয়ী — যাকে বলে নাড়ির বাঁধন — একদিকে, নিউ ইয়র্কে থাকে কবি শহীদ কাদরী ও নাজমুন নেসা পিয়ারির একমাত্র আত্মজ; অন্যদিকে, বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার বিপুল কিলবিল, নিউ ইয়র্ক তাকে ডাকে।

পিয়ারি বাংলা ভাষা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের দুটো বনেদি পুরস্কার ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন। ডয়েসল্যান্ডে ডয়েচ ভাষাস্রোতে ডুবে থাকলেও বাংলার সঙ্গে তিনি আসঙ্গ। তার শাড়ির আঁচলে ও জমিনে বাংলা। খোপা খোলাচুলে বাংলা। তার অন্তরতম অণ্বয় বাংলা।

পাখিরা যে তুষার ঢাকা তারার আকাশ উড়ে যায় সবুজ পাতার উষ্ণতার কাছে সে আকাশে ও অভয়ারণ্যে কী থাকে শুধুই অনাবিল ওড়াউড়ি?

নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলায় তিনি আসেন। এবার এসেছিলেন মিথনারী সুচিত্রা সেনের ওপর কী যেনো একটা অনুষ্ঠানে। সামনের মাসে বইমেলা। থাকবেন কী তিনি সেই পর্যন্ত? পিয়ারি ছাড়া বইমেলা ভাবতেই পারি না।

কথা ছিল এবার পিয়ারির সঙ্গে পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান এবং আমি আড্ডা দেবো কুইন্সের হৈচৈ অথবা লং আইল্যান্ডের কোজি কোনো রেস্তরাঁয়। কথা ছিল রাত নটায় জ্যাক্সন হাইটস থেকে পিয়ারিকে তুলে নেবো। তুলে নেবো শব্দটার মধ্যে কেমন একটা অ্যাবডাকশন এর কনোটেশান থাকে যেমন গ্রীক পুরাণে পার্সেফেনি বা কোরিকে তুলে নিয়েছিল হেইডিস।

শব্দ সব সময় জটিল বাহন — ভাবনাকে প্রায়শঃই দ্বৈত্ব করে।

জ্যাক্সন হাইটসে নাজমুল আহসান এবং আমি অপেক্ষা করছিলাম প্রিয়বন্ধু পিয়ারির জন্য। সাড়ে নটা নাগাদ ফ্রি হতেই তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন।

আমরা তিনজন মিলে প্রতিবারের মতো একটা এক্সক্লুসিভ আড্ডা দিতে চললাম জ্যাক্সন হাইটস থেকে হিলসাইডে। নাজমুল আহসান ফোন দিলেন নিউ ইয়র্কের ভোজন-ক্রেজ বা epicure craze খলিল বিরিয়ানির সত্বাধিকারী খলিল ভাইকে। পিয়ারী আপার কথা শুনেই উল্লসিত বললেন চলে আসুন ব্রঙ্কসে। আমি নিজ হাতে পিয়ারি আপার জন্য একটা দেশি রেসিপি তৈরি করবো।

দশ এগারো মাইল পথ ছুটে গেলাম আমার সদ্য কেনা ফোর্ড এস্কেপ টাইটেনিয়াম ছুটিয়ে। আমাদের সামনে ছিল তিনটে ব্রীজ— হোয়াইট স্টোন ব্রীজ, ট্রাইবরো ব্রীজ ও থ্রগস নেক ব্রীজ। এর যে কোনো একটি পার হলেই কুইন্স থেকে ব্রঙ্কসে ঢুকে পড়া যায়। আমরা নিলাম থ্রগস নেক ব্রীজ।

ব্রঙ্কসে ঢোকার সময় পিয়ারি বললেন এখানে লেখিকা জুলি রহমান থাকে। আমি বললাম আরেকজন কবি থাকে বেনজীর শিকদার। শুনেছি চোখে পড়ার মতো লিখছে। এই ব্রঙ্কসের প্রতিভাবান চিত্রনাট্য লেখক প্যাডি চ্যাপস্কির কথা জানি ১৯৭৫ থেকে। তার লেখা চিত্রনাট্যের জন্য চ্যাপস্কি তিনবার অস্কার পেরেছিলেন যেটা হলিউডে অনতিক্রম্য।

মার্কিন লেখক নোবেল লরিয়েট উইলিয়াম ফকনার জীবনের নিদারুন অর্থকষ্টের দিনে কুড়ি বছর ধরে হলিউডে স্ক্রিনপ্লে লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাই তাকে বলা হয় “Faulkner’s Hollywood Odyssey”

কিন্তু স্ক্রিনপ্লে লেখার জন্য তিনি কখনোই অস্কার পাননি। অথচ সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ছাড়াও দুবার পুলিৎজার, দুবার National Book Award, এবং American Academy of Arts and Letters Gold Medal পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তা ছাড়া ফকনারের ইয়াকনাপাটাফা Yoknapatawpha থেকেই মার্কেজ লিখেছিলেন মাকান্দো।

শুধুমাত্র রুটি রুজির প্রয়োজন মেটাতে কোন কাজ করলে সেখানে সৃস্টির মনটা বসে না। আট ঘন্টা শুধু শরীরটাই খাটে। আমরা খাটতে খাটতে চারুচিত্ত শ্রান্তির কবরে ঢুকিয়ে বেঁচে থাকি শরীর সর্বস্ব। যা লিখি তা অসারবান।

আমরা কথায় কথায় ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার এলাকায় খলিল বিরিয়ানি হাউসে পৌছে যাই। নিয়ন আলোয় ভাসছিল খলিল কমপ্লেক্স। মাল্টাই-এথনিক সংস্কৃতির আর্কিপিলাগো আমেরিকায় খলিল বিরিয়ানি যেনে একখন্ড বাংলাদেশ — একটি সদর্প বদ্বীপ।

সাহস আছে খলিলের বলতেই হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদ নাভারনের ছেলে খলিল নিউ ইয়র্কে এসে সুঠাম প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করেছে তার অনন্য রেসিপি রেস্তরাঁ। খলিলের ব্যাপকতা ও বৈচিত্র হিলসাইডের খলিল বিরিয়ানিতে পাওয়া যাবে না। পেতে হলে যেতে হবে ব্রঙ্কসে।

পিয়ারির সম্মানে খলিল নিজহাতে বানিয়েছিলেন পালং শাক ও চিংড়ি, ফুলকপি টম্যাটর সঙ্গে আলু রুই। তার সঙ্গে ছিল চিকেন কাবাব। শেষে মিস্টি এক্কেবার খুলনা, যশোরের মতো।

খেতে খেতে মনে পড়ছিল আমার একটি লেখার কথা। ‘গাবোর সঙ্গে বুব্বার ডিনার এবং ম্যাজিকাল রিয়ালিজম’। বুব্বা ও গাবো দুজনই ছিলেন ফুডি — সুস্বাদু পান ভোজনে আসক্ত। বুব্বা প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের এবং গাবো গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর আদুরে নাম।

খাবারের জন্য আকুল (epicure) সব চরিত্র আছে মার্কেজ এর অনেক উপন্যাসে।

উরসুলার মিল্ক ক্যান্ডির কথা আমরা জানি। অরেলিয়ানো সাগুন্দো তো খেতে খেতে প্রায় অক্কা পেয়ে গিয়েছিল ফুড কম্পিটিশনে।

মার্কেজের দামি খাবারের প্রতি আকুলতার কথা জেনেছিলাম। তিনি সস্ত্রীক নিউ ইয়র্ক থেকে মেক্সিকো যাচ্ছিলেন। আক্ষরিক অর্থে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণটা ছিল তার কিউবা কানেকশান। তিনি কিউবার প্রেস এজেন্সি “প্রেনসা লাতিনা”তে কাজ করতেন। থাকতেন ম্যানহাটানে ফরটি ওয়েস্ট ফরটি-ফিফথ স্ট্রীটের হোটেল ওয়েবস্টারে যেটা এখন ক্লাব কোয়ার্টার।

এফবিআই তার নিউজ এজেন্সির ওপর, তার চলাফেরা ও কাজবাজের মাইক্রোমনিটরিং করছিল। মার্কেজের লাইফ-লং ফ্রেন্ড কিউবার লেখক লানিও আপিলিয়া তাকে দেড়শ ডলার কর্জ দিয়ে দ্রুত নিউ ইয়র্ক থেকে সটকে পড়ার পরামর্শ দেন।

মার্কেজ ও তার স্ত্রী মার্সেডিজ গ্রে হাউন্ড যাত্রীবাহী আন্ত:রাজ্য বাসে করে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯৬১ সাল।

মার্কেজের অর্থসল্পতার কারণে এবং সেগ্রিগেটেড সমাজের বাসস্ট্যান্ডে, সব রেস্তরায় ঢুকতে বাধার মুখে পড়ে ড্রাইফুড খেয়ে কাটিয়েছিলেন। নিউ অর্লিন্সে পৌছে দেখতে পেলেন হাই-ক্লাস ফ্রেঞ্চ রেঁস্তরা, Le Vieux Carre. সেখানকার উপাদেয় খাবারের মধ্যে ছিল bouillabaisse বুইয়াবেসে, ফিশ স্ট্যু। সেটা তিনি এবং তার স্ত্রী মার্সেডিজ খেয়েছিলেন অনেকগুলো ডলার খরচ করে।

মার্থা’স ভিনিয়ার্ডে এডগার্টনের ‘এসপ্রেসো লাভ’ কফি শপের মালিক ক্যারল ম্যাকমানাস ক্লিন্টনের জন্য স্ট্রবেরিজ, ব্লুবেরিজ এবং ক্রমিচিজ দিয়ে একটা স্পেশাল মাফিন বানিয়েছিল। সেটার নাম রেখেছিল ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মাফিন’।

আমরা বুব্বা ও গাবোর মতো এপিকিউরিয়ান নই। তবু খলিলের উষ্ণ আথিতেয়তায় ব্রঙ্কসে আবার যাওয়ার টান অনুভব করছি। যেমন মার্থা’স ভিনিয়ার্ড ক্লিন্টনকে টেনেছিল প্রবল। তেইশ বছর পর শেষবার যখন ক্লিন্টন মার্থা’স ভিনিয়ার্ডে অবকাশ কাটাতে যান, জেনেছিলেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মাফিন’ তখনো ক্যারলের মেন্যুতে রয়েছে। ক্লিন্টন বলেছিলেন, “আই ওয়ান্ট টু মিট দ্য লেডি হু ওয়াজ ডুয়িং দ্য বেকিং ফর মি।”

খলিল বিরিয়ানী হাউজের দেয়ালে দেয়ালে ডিসপ্লে রয়েছে খলিলের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক স্টেট এর মেয়ের থেকে শুরু করে মার্কিন কংগ্রেস পার্সনদের ছবি। খলিল বিরিয়ানী হাউজেও আছে ‘বাইডেন বিরিয়ানী’ ক্যারলের মেন্যুতে যেমন রয়েছে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মাফিন’।

নাজমুন নেসা পিয়ারি আবার যখন আসবেন নিউ ইয়র্কে, জানি সময় করে যাবেন ব্রঙ্কসের খলিল বিরিয়ানী হাউজের খাবার ও খলিলের উষ্ণ আথিতেয়তার টানে। আমরা পিয়ারির নতুন কবিতা ও বইয়ের মলাটের প্রচ্ছদে চোখ রেখে বলবো, বসন্ত এসে গেছে পর্ণমোচী ডালে সবুজ পাতার ঢেউ। অনন্তবসন্ত নাজমুন নেসা পিয়ারি, আপনি আমাদের অনেক প্রিয়। ফের দেখা হবে। নিউ ইয়র্ক, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

শেয়ার করুন