নিউইয়র্ক     রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিট পোশাকই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের রফতানি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০১:০০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৩ | ০১:০৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
নিট পোশাকই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের রফতানি

আশির দশকে শার্ট ও প্যান্টের মতো ওভেন পোশাকই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য। ওই সময় মোট রফতানিতে ওভেন গার্মেন্টের অংশ ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। এরপর ধীরে ধীরে নিট পোশাকেও সক্ষমতা তৈরি হয় বাংলাদেশের। পর্যায়ক্রমে মোট রফতানিতে ওভেন ও নিট গার্মেন্টের অংশগ্রহণে আসে সমতা। তবে গত এক দশকে এ চিত্র বদলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রান্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশের মোট রফতানিতে ওভেন পোশাকের অংশ কমছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নিটওয়্যারের। পণ্যভিত্তিক তথ্য বিবেচনায় নিট পোশাকপণ্যই টিকিয়ে রেখেছে রফতানি খাতকে।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। ধরন বিবেচনায় পোশাক মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—ওভেন গার্মেন্ট ও নিটওয়্যার। মোটাদাগে টি-শার্ট, পোলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টসকে বলা হয় নিটওয়্যার। অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম জিন্স ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা অনুযায়ী, সর্বশেষ গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকেও মোট রফতানিকে এগিয়ে নিয়েছে নিটওয়্যার পোশাকপণ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের এক্সটার্নাল ইকোনমিকস শাখা থেকে নিয়মিতভাবে তৈরি পোশাকের প্রান্তিক পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘কোয়ার্টারলি রিভিউ অন রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি): অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২২-২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত প্রান্তিকে মোট রফতানির সবচেয়ে বড় অংশ ছিল নিটওয়্যার, শতাংশের হিসাবে যা ৪৭ দশমিক ৩২।

নিটওয়্যারের পরের অবস্থানে ছিল ওভেন পোশাক। মোট রফতানিতে ওভেন পোশাকের অংশ ছিল ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অংশ ছিল ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, কৃষিপণ্যের ১ দশমিক ৫৩, পাটজাত পণ্যের ১ দশমিক ২৭, হিমায়িত খাদ্যপণ্যের শূন্য দশমিক ৭১, রাসায়নিক পণ্যের শূন্য দশমিক ৫৮ ও অন্যান্য পণ্যের অংশ ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

নিট পোশাকপণ্যের সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, কভিডকাল থেকেই ক্যাজুয়াল পোশাকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। পাশাপাশি মানুষের নিত্যব্যবহার্য যেসব পোশাক সেগুলোরও চাহিদা বাড়ছে। এসব পোশাকের অধিকাংশই নিট পোশাক। ফলে সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে নিট পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি এখন ম্যান মেড ফাইবারের চাহিদাও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে। এক্ষেত্রেও অধিকাংশ পণ্যই নিট পোশাক। যদিও ম্যান মেড ফাইবারের সুতা-কাপড়ে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর, কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমদানি করে হলেও নিট পোশাকের রফতানিটাই বেশি বাড়ছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘যেহেতু চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, নিট পোশাকের রফতানিও বাড়ছে। এ মুহূর্তে মোট পোশাক রফতানির ৫৫ শতাংশের বেশি নিট পোশাক। এটা আরো বাড়বে। আমরা ধারণা করছি, এ বছরটা খারাপ যাবে। কিন্তু আমরা আশাবাদী যে যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে ২০২৪ সালে নিট পোশাক রফতানি আরো বাড়বে। আশা করছি ২০২৪ সাল খুব ভালো যাবে। ক্রেতারাও তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন।’

মোট রফতানিতে নিট পোশাকের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চিত্রটি স্বাভাবিক ধারা বলে মনে করছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনেক দিন ধরেই রফতানিতে নিট পোশাকের অংশ বাড়ছিল। যদিও শুরুটা ছিল ওভেন পোশাকের হাত ধরে। ওভেনের অংশ কমে যাওয়া এবং নিট পোশাকের বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ঘটেছে পর্যায়ক্রমে ধীরগতিতে, যার মূল কারণ নিট পোশাকের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সক্ষমতা। স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত থাকা অনেক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছিল ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থমূল্য বিবেচনায় ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক, যার ৪৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ রফতানি হয় ওভেন গার্মেন্ট। বাকি ৩৯ শতাংশ পোশাক ছিল নিটওয়্যার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। অর্থমূল্য বিবেচনায় এসব পণ্যের ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ৫৪ শতাংশই ছিল ওভেন গার্মেন্ট। আর নিটওয়্যার ছিল ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ থেকে তিন বছরের ব্যবধানেই মোট রফতানিতে ওভেনের অংশ কমে যায়। অন্যদিকে নিটওয়্যারের অংশ বেড়ে যায়।

ওভেনের অংশ কমে নিটওয়্যারের অংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৮-১৯-এর পরও। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়, যার ৮৩ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। ৪১ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল ওভেন গার্মেন্ট। ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ ছিল নিটওয়্যার।

২০২১-২২ অর্থবছরেও মোট রফতানিতে ওভেন গার্মেন্টের অংশ কমে যাওয়ার গতি অব্যাহত ছিল। গত অর্থবছরে মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের। পোশাক রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ৩১ লাখ ডলারের। রফতানির ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক, যার ৩৭ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল ওভেন গার্মেন্ট। বাকি ৪৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল নিটওয়্যার রফতানি।

ক্রেতারা দ্রুত ক্রয়াদেশ নিতে চাচ্ছেন, এমন তথ্য উল্লেখ করে পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, ফাস্ট ফ্যাশনের চাহিদা ওভেন পোশাকের চেয়ে নিট পোশাক শিল্প বেশি মেটাতে পারছে। নিট পোশাকের সুতা-কাপড়ের সিংহভাগ যেহেতু স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, তাই এটা সম্ভব হচ্ছে। ওভেনের ক্ষেত্রেও কাঁচামালের স্থানীয় সক্ষমতা আছে, কিন্তু এখনো বড় একটি অংশ আমদানিনির্ভর রয়ে গেছে। ফলে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ দ্রুত সরবরাহ করাটা নিট পোশাকের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব, ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে ততটা নয়।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্রেতাদের কাছে নিট পোশাকের জন্য বাংলাদেশ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ কাঁচামাল উৎপাদন সক্ষমতা। কভিড প্রেক্ষাপট ছাড়া নিট ও ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের ব্যবহার বা ক্রয় আচরণে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে নিট পোশাকের ধরন বা বৈচিত্র্য অনেকটা বেড়েছে। ফলে ভোক্তাদের পোশাক ব্যবহারের যে ধারা সেখানে কিছুটা পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। আবার ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে কাঁচামাল উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় ওভেন গার্মেন্টের জন্য ভিয়েতনাম বা পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের মোট রফতানিতে নিট পোশাক ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে।’ – সুত্র বণিকবার্তা

শেয়ার করুন