বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, নির্বাচনের অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে, এটা স্বস্তির বিষয়। এখন পাইপলাইনে যেসব প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত যে ঋণ গত কয়েক মাসে ছাড় হয়নি, সেগুলোও এখন ছাড় হবে। বাণিজ্য অর্থায়নেও গতি আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মুদ্রানীতি ঘোষণার পরে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এর মধ্যে ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার ও রিজার্ভ–সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, তারল্যসংকট, পাঁচ শরিয়াহ ব্যাংকের সংকট, বেসরকারি খাত, খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের ওপর আস্থার বিষয় ইত্যাদি।
এ সময় গভর্নর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানো জরুরি, সেই সঙ্গে সরবরাহব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে যেন প্রভাব না পড়ে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, তা নিশ্চিত করতে আমাদের বেশ কয়েকটি পুনঃ অর্থায়ন প্রকল্প রয়েছে। সাধারণ ঋণের সুদহার এখন ১২ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে, কিন্তু এসব ঋণের সুদ ৪ থেকে ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এখন মাথাব্যথা নেই। আমাদের এখন মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, সে জন্য প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ কমলেও সমস্যা নেই।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ : সরকারের রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতি কতটা সংগতিপূর্ণ, এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নতুন সরকারের রাজনৈতিক ইশতেহারের সঙ্গে মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে সুশাসন ও দক্ষতা বৃদ্ধির অঙ্গীকার ছিল সরকারের। দুটি বিষয়ই আমলে নেওয়া হয়েছে।
নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব হবে, এই প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির দুটি দিক; একটি অর্থনৈতিক, আরেকটি অর্থনীতিবহির্ভূত। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক দিকটি আমলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়টি আমলে নেওয়ার জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে হয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে নতুন অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আগামী রোববার এ নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করছে, এখন সরকারের অন্যান্য সংস্থা তাদের ভূমিকা পালন করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’
ডলার ও রিজার্ভ–সংকট : ব্যাংক থেকে বড়রা ডলার পাচ্ছে, ছোটরা পাচ্ছে না, এতে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা চলতি হিসাব নিয়ন্ত্রণ করেছি, তাতে কিছু মানুষের কষ্ট হচ্ছে, কিছু ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। একটা সময় বছরে ৯০ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে, কিন্তু সেটা যথাযথ ছিল না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কিন্তু ডলার দেওয়া হচ্ছে। সেটার জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে বলেছি, ডলার থাকলে ঋণপত্র খোলা যাবে, এতে সমস্যা নেই। তবে চলতি হিসাব আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। কারণ, এক বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হলে আমাদের আর কোনো রিজার্ভ থাকত না।’
রিজার্ভের ওপর চাপ কমে আসছে, সেটা কতটা কমেছে—এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘গত দেড় বছরে আমাদের ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন। সে জন্য রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছিল। এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণের দায় মোটামুটি শোধ হয়ে গেছে।’
পাঁচ শরিয়াহ ব্যাংকের সংকট : ইসলামি ধারার যে পাঁচ ব্যাংক সংকটে আছে, সেগুলো একই গোষ্ঠীর মালিকানাধীন, সে কারণেই কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না—এই প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় আছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাঠামোতে সমস্যা আছে। মূলধারার ব্যাংকগুলোকে ১৫ শতাংশ এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয়; ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংকগুলোর সুকুক বন্ড খুব বেশি দিন আগে চালু হয়নি, আমি যখন অর্থসচিব ছিলাম, তখন এটা চালু হয়। কিন্তু সেটাও পরিমাণে খুব কম। আমরা জানি, ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদে ঋণ করে, কিন্তু ঋণ দেয় দীর্ঘ মেয়াদে। সেখানে একধরনের সামঞ্জস্যহীনতা আছে।’
আব্দুর রউফ তালুকদার আরো বলেন, ‘তারল্যসংকটের মূল কারণ হলো, ডলার আসা কমে গেছে। সে কারণে বাজারে টাকা ছাড়ার পরিমাণ কমেছে। অথচ আমরা চলমান অর্থবছরসহ গত তিন অর্থবছরে বাজারে ২৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৮৭০ কোটি ডলার বিক্রি করেছি। অর্থাৎ সেই পরিমাণ টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এর সমপরিমাণ টাকা কিন্তু বাজারে সঞ্চারিত করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকগুলো ডলার কেনায় তাদের কাছে টাকা নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্ট মাস থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে। সরকার এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বদলে আর্থিক খাত থেকে ঋণ করছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা কমে যাচ্ছে। এটা কাঠামোগত সমস্যা; আমরা তা মোকাবিলার চেষ্টা করছি। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।’
গভর্নর আরও বলেন, শুধু ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো নয়, মূলধারার ব্যাংকগুলোও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ধার করছে। ‘লেন্ডার অব লাস্ট রিসোর্ট’ বা শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ দিতে পারে। গভর্নরকে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে। আইনের মধ্যে থেকেই ইসলামি ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হচ্ছে।
চাপ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘আমি নিয়মিত চাকরি ছেড়ে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে এসেছি। আমি যেকোনো সময় চাকরি ছেড়ে দিতে পারি, আবার সরকারও আমাকে চাকরি ছাড়তে বলতে পারে। ফলে চাকরি হারানোর ভয় আমার নেই। আমাকে কেউ ভয় দেখাচ্ছে, এমন বিষয়ও নেই।’- সুত্র দৈনিক প্রথম আলো