নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

স্মার্ট ক্যাফের টেবিলে পিয়ারী-প্রমগ্ন সখ্য সময়

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪ | ০১:১৯ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ | ০১:১৯ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
স্মার্ট ক্যাফের টেবিলে পিয়ারী-প্রমগ্ন সখ্য সময়

সোমবার সন্ধ্যার আড্ডাটা ছিল কথা মিথস্ক্রিয়ার অধিক এক দৃকাড্ডা। ভেন্যু ছিল হিলসাইড এভেন্যুর স্মার্ট ক্যাফে। স্টোনসাদা রংয়ের গোলটেবিল ঘিরে বসেছিলাম আমরা কজন ‘লাভার অব ওয়ার্ডস’ বা লোগোফাইল’, যাদেরকে অনেকেই মজা করে ডাকে লগোম্যানিয়াক।

এদিনের আড্ডায় এসেছিল নিউ ইয়র্কের ছয় কথাপ্রেমী নারী। সেখানে ছিলেন উচ্ছলপ্রাণ রওশন হাসান, ইডেনের রেশমা, নিপা, লেখক ভায়লা সেলিনা লিজা, কবি, লিরিসিস্ট, কথা সাহিত্যিক রূপা খানম। আড্ডার সেন্টার-অব-গ্রাভিটি বা অভিকর্ষ ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় পিয়ারী। বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক ‘বার্লিন কন্যা’ নাজমুন নেসা পিয়ারী।

তিনি বাংলা কবিতার রাজপুত্র শহীদ কাদরীর “কারুকাজে-ভরা জ্বলজ্বলে সরোদের মতো —- জলদ-গম্ভীর কিছু ঝংকার — শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো অ্যাকর্ডিয়ান।”

তিনি নন্দনকাননের মতো অফুরান বসন্ত। তিনি কবিতা ডানায় উড়ে আসেন রাইন নদীর জলজ অর্কেস্ট্রা।

কবিরা উড়াল-স্বভাব না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

পিয়ারী ফিবছর নিউ ইয়র্কে আসেন নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে। তাকে ঘিরে এখানকার নারী লেখকরা ডানা ঝাপটায়। তিনি এলে তারা কালিনারি শিল্পের টুংটাং শব্দকে পিছনে ফেলে বেজে ওঠেন ‘ফ্রি রীড অ্যারোফোন’। তারা পিয়ারীর জন্য তৈরি করেন সযত্ন তন্ময়তায় ‘পিয়ারী-প্রমগ্ন সখ্য সময়’।

পিয়ারীকে নিয়ে নাজমুল আহসান এবং আমি যখন জ্যামাইকার হিলসাইডের স্মার্ট ক্যাফেতে ঢুকলাম তখন টেবিলে রওশন হাসান একা বসেছিল। যাকে আমরা ‘ঝর্ণাকন্যা’ বলি সে তখন একা বসেছিল ঝর্ণা-জলমগ্ন উপলের মতো নিশ্চল। মরুজও বটে।

পিয়ারীকে পেয়ে রওশন জড়িয়ে ধরলো উচ্ছল। তখন ছুটলো তার নির্ঝরীনি।

রওশন ইংরিজি ভাষা-সাহিত্যের মাস্টার্স। মূলতঃ কবি। অনুবাদ করেন ইংরিজি ও ফরাসি কবিতা। অনুবাদে তার বৈশিষ্ট তিনি অনুদিত কবিতার সঙ্গে মূল কবিতা জাক্সটাপোজ করেন পাঠকের কাছে তার অথেন্টিসিটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। রওশন ইউক্যালিপ্টাস বৃক্ষের ট্রাঙ্কের মতো ঋজু দীর্ঘাঙ্গী। তাকে কাব্যিক অভিধায় ডাকি ‘চন্দ্রালোক প্রিয়দর্শী’। চারুশ্রী ও নানাবিধ গুণের জন্য তিনি ঈর্ষার শিকার হন।

নাজমুল আহসান একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি কবি রওশন হাসানকে সব সময় সামাজিক ও সাহিত্যিক বলয়ে মেল-শভিনিস্ট, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, ম্যানিয়াকদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাপোর্ট দিয়েছেন।

রওশন হাসান মার্কিন মুলুকে বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা কবি ও লেখকদের মধ্যে ডাইনামিকলি গ্রোয়িং লেখক। সম্প্রতি আমাজন পাবলিশিং থেকে তার একটি ইংলিশ নভেল বেরিয়েছে। বইটির নাম Land of Dreams — চোখ চমকে দেয়া কভার। আমরা বইটির বিপুল কাটতি প্রত্যাশা করছি।

নিউ ইয়র্কের সবগুলো লুলা ল্যাংড়া কাগজ যখন আমার লেখা বয়কট করেছিল তখন নাজমুল আহসান তার অভী নির্ভীক কাগজ সাপ্তাহিক পরিচয় এর পাতা আমার লেখার জন্য মেলে ধরেছিলেন।

এদিনের আড্ডা আয়োজনের ক্যাটালিস্ট ও ব্রিজিং দ্য গ্যাপ ছিলেন নাজমুল আহসান।

আড্ডার আয়োজন করেছিল কবি রওশন হাসান। আমি বলি, রওশন হাসান রচিত সাহিত্য আড্ডার অ্যান্থলজি।

সব সাহিত্য আড্ডা সাহিত্যের প্যারাডাইম শিফট এর ক্ষেত্রে যেমন প্রভাব রাখে। তেমনি করে সাহিত্য আড্ডায় মেলে ব্যক্তিগত উৎকর্ষ ও অর্জন। এদিনের আড্ডায় আমার মিলেছিল দুজন লেখক সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি। রূপা খানম ও ভায়লা সেলিনা লিজার স্নিগ্ধ ব্যবহারে আমি মায়াবিষ্ট হয়ে পড়ি। তাদেরকে দেবশিশু মনে হয়েছিল। সেদিন নিকটে যখন রূপা খানমকে সেই সাংবাদিক বলবে ‘সব্যসাচী’ লেখক জহিরকে যে বলে সব্যসাচী।

নারী কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডার ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়িনি। তবে প্যারিসের অন্ততঃ দুটো নারী প্রাধান্যের আড্ডাকথা জানি। ফরাসি সাহিত্য ও দর্শনের ল্যান্ডস্কেপে সেই দুটো নারী কেন্দ্রিক আড্ডার কথা শিল্প সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

প্যারিসে স্বশৈলী মার্কিন জিনিয়াস লেখক, আর্ট-কালেক্টর গার্ট্রুড স্টেইন এর আইকনিক স্যালন লিগ্যাসির কথা জানি। 27 rue de Flerus রু দ্যু ফ্লার যেটাকে বলে “the street of flowers” সেখানে তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল একটা কালচারাল স্যালন। তখনকার এবং পরবর্তীকালের শীর্ষস্থানীয় লেখক ও চিত্রকরেরা সেখানে নিয়মিত আড্ডা দিতো।

গার্ট্রুডের স্যালন হয়ে উঠেছিল মেগা লেখক ও চিত্রকরদের চিন্তা ভাবনার এপিসেন্টার। সেখানে নিয়মিত জড়ো হতো পিকাসো, হেমিংওয়ে, হেনরি মাতিস. এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, পল সেজান ও অন্যান্য জগৎখ্যাত ধীদীপ্ত দিকপাল। গারট্রুড স্টেইনের প্যারিস সেলন ছিল আমেরিকান, ইউরোপীয় শিল্পী এবং লেখকদের একটি জমায়েত। সেই আড্ডা শিল্প ও সাহিত্যের আধুনিকতাকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করেছিল।

সেখানে গেলে দেখতে পাবেন ছোট্ট একটা মার্বেল ফলকে লেখা আছে, ‘দ্য কুইন অব আমেরিকান এগজাইলস ইন প্যারিস’।

সীমন দ্য ব্যুভয়াকে কেন্দ্র করে প্যারীর সবচে প্রিয় Café de Flore এ গড়ে উঠেছিল আরেকটি সমৃদ্ধ আড্ডা। ক্যাফে দ্যু ফ্লোরকে বলা হয় ‘বার্থপ্লেস অব আইডিয়াস’, যেখানে স্যুররিয়ালইজম বা পরাবাস্তববাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এ কথায় কেউ কেউ কনফিউজড হতে পারেন সে জন্য বলে রাখছি স্যুররিয়ালইজম এর আনডিসপিউটেড পোপ বলে খ্যাত ফরাসি কবি ও লেখক আদ্রে ব্রেতঁ ছিলেন স্যুররিয়ালইজম এর প্রিন্সিপাল থিওরিস্ট। তিনি লিখেছিলেন স্যুররিয়ালইজম এর মেনিফেস্টো।

এটি ছিল সৃজনশীল মনের জন্য একটি মূল জায়গা। নারী কেন্দ্রিক এই আড্ডায় শুধু নারীরাই কেন্দ্রিভূত হতো তা কিন্তু নয়। সেখানে সমবেত হতো অনেক মশহুর পুরুষ লেখক ও কবি।

আরেকটি আড্ডার কথা সাহিত্য ও দার্শনিকতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে সেটা Existential Cafe আড্ডা। যদিও জাঁ পল সার্ত্রে এবং সিমন ডি ব্যুভয়াকে অস্তিত্ববাদের মহাযাজক (high priest) এবং (priestess) পুরোহিত হিসাবে বিবেচনা করা হতো তথাপি সেখানে দুনিয়ার সেরা লেখকেরা যেতো। তাদের মধ্যে আলবার্ট কাম্যু, মরিস মার্লো পন্টি, অ্যারন রেমন্ড, গাব্রিয়েল মার্সেল, সরেন কিয়ের্কেগার্ড ও অন্যান্য লেখক।

লন্ডনে এক সময় বিশাল মাপের সব কবি ও লেখকদের আড্ডা হতো। সেগুলো ছিল মূলতঃ পুরুষ কবি ও লেখকদের আড্ডা।

লন্ডনে ইয়েটস ‘মানডে ইভনিংস অ্যাট হোম’, ‘আর্নেস্ট রাইস ইভনিং’, ‘টি.ই. হুমস ইভনিং’, ‘মিটিংস অব দ্য পোয়েটস ক্লাব’ এর আড্ডা। তখনকার ওইসব কবিতা ও সাহিত্য আড্ডা গুলো ছিল কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিরন্তর ধারায় কবিতাকে নতুন সচেতনতায় জুড়ে দেয়ার এবং তাকে উস্কে দেয়ার আড্ডা। রোমান্টিসিজম থেকে মর্ডানিস্ট কবিতার ধারা অতিক্রমের আড্ডা।

আড্ডা শেষে লং আইল্যান্ডে পিয়ারিকে পৌছে দিই তার বোনের বাসায়। সব আনন্দ শেষ হলে বুকের ল্যান্ডস্কেপ দখল করে মিলাঙ্কোলিয়ার বিষন্ন বাতাস। আমি চলে যাই আটলান্টিক মোহনা মোড়ে। ঢেউ গর্জনের শব্দে ঢাকতে চাই হৃদয়পুরের মিলাঙ্কোলিয়া। আমিতো ওস্যানোগ্রাফার নই যে শুনতে সক্ষম হবো সমুদ্রের জলজ অর্কেস্ট্রা। তাই ঢেউয়ের বিরুদ্ধে বাজাই মোজার্টের পিয়ানো সনাটা নং ১১ এ মেজর ৩৩১ কে। ওটা বাজিয়েছে ড্যানিয়েল ব্যারেনবোয়েম।

বিষন্নতার নিতলধ্বনিকে ঢাকতে অতলান্তিকের ঢেউস্বনন শুনতে যাই। সরাতে পারিনা। তাকে সরাতে শুনি মোজার্টের সনাটা পিয়ানো বাদন। মধ্যরাতের বেল্ট পার্কওয়ে ধরে ডেরায় ফেরার পথে আউড়াই শহীদ কাদরীর ‘এ ও সঙ্গীত’ কবিতাটি। চিত্রপ্রধান প্রতীকী কবিতা। কবিতাটি আমার প্রিয়।

নিউ ইয়র্কের কতিপয় intellectually dishonest সম্পাদক উঠতি কবিদের (বিশেষ করে মহিলা কবিদের) সর্বনাশ করে চলেছে তাদের হাইপারবোল প্রশংসা করে। যারা এখানে কবিতা লেখেন এবং কম্যুনিটি কাগজের সাহিত্যপাতার দেখভাল করেন তাদের উচিৎ কাদরীকে বারবার পড়া। কাদরীর প্রতিটি কবিতা কাব্য শিল্পের অমূল্য জেম। নিউ ইয়র্ক, মে ২০২৪

শেয়ার করুন