নিউইয়র্ক     রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দায় মেটানোই এখন দায় ২০ ব্যাংকের

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২২ | ০৩:৩২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২২ | ০৩:৩২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দায় মেটানোই এখন দায় ২০ ব্যাংকের

পাঁচ কোটি ২০ লাখ ডলার সংরক্ষণের অনুমোদন রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। আমদানি দায় পরিশোধের পরও এ পরিমাণ ডলার নিজেদের হিসাবে সংরক্ষণ করতে পারে ব্যাংকটি। তবে বর্তমানে এই ব্যাংকটির কাছে দায় মেটানোর মতো কোনো ডলারই নেই। উল্টো ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে ঘাটতি। আর সেটা মেটানো হয়েছে গ্রাহকদের হিসাবে থাকা ডলার ভাঙিয়ে। সংকটের কারণে যথাসময়ে ঋণপত্রের (এলসি) দায়ও পরিশোধ করতে পারছে না অগ্রণী ব্যাংক। এলসি দায় পরিশোধেও নিয়মিত সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে এই ব্যাংকটিকে।

একই দশা বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের। ইসলামি শরীয়াহ ঘরনার ব্যাংকটির ডলার ধারণক্ষমতা ৫৩ মিলিয়ন। কিন্তু ব্যাংকটির উদ্বৃত্ত কোনো ডলার নেই। উল্টো ৮৮ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে পড়েছে। অগ্রণী কিংবা এক্সিম ব্যাংকের পরিস্থিতি এখন দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, কমপক্ষে ২০টি দেশীয় ব্যাংকের কাছে এলসি দায় মেটানোর মতো কোনো ডলার নেই। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়েই ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় থেকে সংগৃহীত ডলার দিয়েও নিজেদের আমদানি দায় ও গ্রাহকদের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে আমদানির নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলাও বন্ধ রেখেছে। যে কয়েকটি ব্যাংকের কাছে এখনো ডলার আছে, সেগুলোও কমে আসছে। আর এ সংকটের কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার।

এদিকে ডলার সংকটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। কোনো কোনো দায় পরিশোধে এক মাসও বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় এলসির নিশ্চয়তা দেওয়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বিদেশি অনেক ব্যাংকই এখন বাংলাদেশের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিতে শুরু করেছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বিদ্যমান ডলার সংকট পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ডলার ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ যে হারে কমছে, তাতে ডলার সংকট আরো তীব্র হবে। ব্যাংকগুলো এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের এলসি নেওয়াই বন্ধ করে দিতে পারে। দেশের অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রায় একই কথা বলেছেন। তবে কেউই নিজেদের নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক, আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এডিসিবি), জার্মানিভিত্তিক কমার্জ ব্যাংক, ভারতের অ্যাক্সিস ব্যাংকের বেশকিছু এলসি দায় নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ব্যাংকও রয়েছে ব্যর্থ হওয়ার তালিকায়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকও নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারেনি।

দেশের মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় ৩০ শতাংশই আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। আবার রপ্তানি আয়ের দিক থেকেও ব্যাংকটির অবস্থান সবার শীর্ষে। তারপরও আমদানি দায় পরিশোধ নিয়ে বিপদে আছে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি।

সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মাশরেক, এডিসিবি, অ্যাক্সিস ব্যাংকের বেশকিছু এলসি দায় নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। কোনো কোনো এলসি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ৩০ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে। যদিও ব্যাংকটির হিসাবে এখনো প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংক তাদের অনশোর ব্যাংকিং থেকে বেশকিছু ডলার অফশোর ব্যাংকিংয়ে স্থানান্তর করে বিনিয়োগ করেছে। এ কারণে নিট এক্সচেঞ্জ পজিশনে ৮৮ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখালেও প্রকৃত অর্থে ব্যাংকটির হাতে ডলার নেই। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এরই মধ্যে অনেক এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব করেছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ছাড়াও ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ কমার্জ ব্যাংকের এলসি দায় পরিশোধে বিলম্ব করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ দেশের এক ডজন ব্যাংকের বিরুদ্ধে এলসি দায় বিলম্বে পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডলার ঘাটতিতে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক ৮৮ মিলিয়ন, ঢাকা ব্যাংক ৬৮, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৬৪, ইউসিবিএল ৪৯, দ্য সিটি ব্যাংক ৪৭, পূবালী ব্যাংক ৪৫, প্রাইম ব্যাংক ৪২ ও সাউথইস্ট ব্যাংক ৪১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৩৫ মিলিয়ন ডলার। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩৪, ওয়ান ব্যাংক ৩২, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২৭, ন্যাশনাল ব্যাংক ২৪, ব্যাংক এশিয়া ১৪ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ১১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ৮ মিলিয়ন ডলার করে ঘাটতিতে রয়েছে ট্রাস্ট, ব্র্যাক ও এনসিসি ব্যাংক। বিদেশী খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনেও চার মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে আমাদের এলসি খোলার পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। গতকাল মঙ্গলবারও (১ নভেম্বর) দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ৬৩ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি শিগগিরই স্থিতিশীল হয়ে যাবে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন