নিউইয়র্ক     রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোজাম্মেল বাবু

হিরো আলমের জন্য উচ্ছ্বাস?

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০২:২৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৩ | ০২:২৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
হিরো আলমের জন্য উচ্ছ্বাস?

বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম মাত্র ৮১৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। ফলাফল না মেনে তিনি আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জ্বালাও-পোড়াও কিংবা হরতাল-অবরোধে না জড়িয়ে তিনি আইনের পথে হাঁটছেন, এটা অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়। আগেও তিনি আদালতে গিয়ে সুরাহা পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশন তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করলেও বিচার বিভাগ তা বহাল করেছেন। এবারও তিনি নিশ্চয়ই আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরবেন। নির্বাচনে হার-জিত আছে, কিন্তু তিনি ভোটারদের কাছ থেকে যে সমর্থন পেয়েছেন, তা অভূতপূর্ব!

হিরো আলমের এ ঘটনায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলাম লেখক আসিফ নজরুলকে চরম উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গেল। কিন্তু তাঁর এ আনন্দ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তারকা হিরো আলমের সাফল্যে নাকি রাজনীতিবিদদের একহাত দেখে নেওয়া গেল বলে? ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয়, ‘হিরো আলম বনাম “এলিট” সমাজ’ শিরোনামের লেখায় তিনি লিখেছেন ‘হিরো আলমকে নিয়ে সমাজের ওপরতলার মানুষের তাচ্ছিল্যের শেষ নেই। এই চেহারা নিয়ে কীভাবে নায়ক হয়? এই কণ্ঠ নিয়ে কীভাবে গান গায়? বিশেষ করে তাঁর রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর শহরের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এমন শোরগোল চরমে ওঠে।’ হিরো আলমের ‘চেহারা’ কিংবা ‘কণ্ঠ’ নিয়ে ওপরতলার মানুষ হিসেবে তিনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, তাতে তাঁর নিজের মনের কথাই বের হয়ে আসেনি তো?

জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া হিরো আলমের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ড. নজরুল দেশের শিক্ষিত সমাজকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তাতে মনে হয় লেখাপড়া করাটা রীতিমতো একটি পাপ! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব যেমন কোনো অপরাধ নয়, তেমনি ‘ডিগ্রি’ না থাকাটাও কারও জনপ্রিয়তার নিয়ামক হতে পারে না।

আসিফ নজরুল তাঁর কলামের শেষ প্রান্তে এসে লিখেছেন, ‘যদি তিনি সুবিচার পান…দেশের সংসদে যোগ্যতাহীন ও দায়িত্বহীন যে সংসদ সদস্য আছেন, তাদের জন্য উপযুক্ত অস্বস্তি তৈরি করতে পারবেন তিনি।’ হিরো আলম দেশের প্রথম স্বতন্ত্র প্রার্থী নন, এমনকি তিনি প্রথম স্বশিক্ষিত প্রার্থীও নন। তাহলে ড. নজরুল কেন মনে করছেন যে হিরো আলম সংসদে এলে ‘উপযুক্ত অস্বস্তি’ তৈরি হবে? তিনি কি তাঁকে ‘অচ্ছুত’ জ্ঞান করেই রাজনীতিবিদদের ‘অস্বস্তি’তে ফেলতে চান? তত্ত্বাবধায়ক বা সুশীলদের সরকারের বিধান বাতিল করাতেই কি তিনি এতটা খেপেছেন?

এ ধরনের অবস্থানের একটি লক্ষ্য হতে পারে ‘বিরাজনীতিকরণ’। রাজনৈতিক নেতাদের হেয় করে এবং জাতীয় সংসদকে তামাশাস্থল বানিয়ে প্রকারান্তরে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য একটা পলিটিক্যাল স্পেস তৈরি করা। ২০০৬-০৭ সালে ‘সৎ ও যোগ্য প্রার্থী’ খোঁজার নামে ‘এক-এগারো’ ডেকে আনা হয়েছিল। একই ধরনের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই কি তবে হিরো আলমদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা?

শুধু আসিফ নজরুল নন, আমাদের অনেকেই হিরো আলমকে প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা ‘স্টেটমেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করছি এবং তাঁর প্রাপ্ত ভোটকে নেহাতই ‘নেগেটিভ ভোটিং’ হিসেবে বিবেচনা করছি—এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘ডাব’ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানো ছক্কা ছায়ফুরের প্রতিও আমরা একই রকম অবিচার করেছি। প্রকৃত বিবেচনায়, হিরো আলম তৃণমূল থেকে উঠে আসা ‘সেলফ মেইড’ একজন মানুষ। তাঁর ২০ লাখ ফেসবুক ফলোয়ার আছেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ২০ হাজার ভোট পেলে আমরা এত বিস্মিত হচ্ছি কেন? এত সব পোস্টমর্টেম করছি কেন? আমরা কি এ ধরনের নতুন নতুন সোশ্যাল মিডিয়া স্টার, ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা নরেন্দ্র মোদির উত্থান দেখিনি?

হিরো আলমকে ঘিরে গণমাধ্যমের একটা অংশ যে আলগা দরদ দেখাচ্ছে, তাতে ঠিক ‘সততা’ আছে বলে মনে হয় না। তারাও এ তারকার জনপ্রিয়তাকে বিবেচনায় না নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে গা ভাসাচ্ছে। তাঁর ঘাড়ের ওপর ভর করে অন্যদের কটাক্ষ করার সুযোগ নিচ্ছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভালো-খারাপ সব ধরনের মানুষই আছেন। তাঁরা দেশটাকে স্বাধীন করেছেন, কখনো কখনো বিপন্ন করার কারণও হয়ে দাঁড়ান তাঁরাই! এখানে ঢালাও বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। হিরো আলমদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাও দুরভিসন্ধিমূলক। এটা অনেকটা জগৎখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এবং রেসলিং শিরোপাজয়ী ইনোকির দ্বৈরথের মতো! অকপট সারল্যই হিরো আলমের ইউএসপি বা নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য, যে কারণে তিনি এত মানুষের ভোট পেয়েছেন। আমাদের তালে পড়ে তিনি সেটাই না খুইয়ে বসেন! তার মধ্যেও না ‘পলিটিকস’

ঢুকে যায়! হিরো আলমকে নিয়ে দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ নয় কি?

আসিফ নজরুল তাঁর লেখার উপসংহারে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, আমরা মুক্তিযুদ্ধটা করেছিলাম এই মানুষদের বিকশিত হওয়ার সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁদের নিগৃহীত, অপমানিত করার জন্য বা বঙ্গবন্ধুর ভাষায় দাবায়া রাখার জন্য নয়।’ এখানে স্পষ্টতই জাতির জনকের বক্তব্যকে আউট অব কনটেক্সট বা প্রসঙ্গবহির্ভূতভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরোধিতা করা ও সুবিধামতো তাঁর উদ্ধৃতি ব্যবহার করার মধ্যে দ্বৈত অবস্থানই প্রকাশ পায়।

সবাইকে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর করার এবং সবকিছুকে নষ্টদের অধিকারে পাঠানোর পরিকল্পনা কখনোই সফল হবে না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্রম উত্তরণ এবং তৃণমূলের অবশ্যম্ভাবী উত্থান—কোনোটাই আখেরে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। মোজাম্মেল বাবু কলাম লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে

শেয়ার করুন