নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

“আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি”

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
“আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি”

কবির কিরণ: ভয়াবহ পরিস্থিতি , চারিদিকে মানুষের বিবেক তাড়িত উদ্ধগতিতে জীবন বাজি রেখে উদ্দেশ্য হীন ভাবে গন্তব্য পথে যাত্রা !বাতাসে বারুদের গন্ধ !জীবন সাহাহ্নের গতি রুদ্ধ , ঠিক মতো চলছেনা জীবনের গতিপথ। ঠিক সেইসময় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।মানুষ কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছিল না।হাজিপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে মাত্র চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠলাম। তথ্যমতে তখন হাজিপুর স্কুল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল।পঞ্চম শ্রেণীতে ভালো করে পড়াশোনা করব, কত স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছিলাম কিন্তু বিধিবাম।শহরের মানুষগুলো গ্রামে মিছিলের মতো আসা শুরু করলো।সবগুলো শহর খালি হয়ে গেল। গ্রামগুলো ভর্তি হয়ে গেল মানুষ আর মানুষে।গ্রামে বাজার বসলো কিন্তু রাজাকারদের অত্যাচারে এবং তাদের ভয়ে প্রতিটা পরিবার আতঙ্কগ্রস্থ ছিল।গভীর রাতে বাবা ( মাস্টার মুরাদুজ্জামান )বড় ভাইকে ( হুমায়ুন কবির দুলাল )মুক্তি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিদায় দিচ্ছেন , আর আম্মা কান্না শুরু করলেন। বড় ভাইয়ের বয়স সম্ভবত ১৭ বছর হবে। আমি তখন ঘুম থেকে উঠে গেলাম , আর আমিও আম্মার সাথে কান্না জুড়ে দিলাম। তার পর কয়েক মাস কেটে গেলো , ভাইয়া তখনও ভারত থেকে ফিরে আসেনি । আমরা তখন বন্ধি জীবনে কারাগারের অন্ধকুপের চেয়েও নিষ্ঠূর জীবন যাপন করছিলাম । চারিদিকে মৃত মানুষের গলিত লাশ খালে বিলে ভেসে বেড়াচ্ছে । আমার বয়স সম্ববত নয় কি দশ হবে ,সদ্য ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস ফাইভে উঠলাম। হঠাৎ খবর আসলো আবু তাহের ( আমার স্কুল , কলেজ , বিশ্ববিদালয়ের বন্ধু ) এবং তার চাচাতো ভাই রাজাকারদের গুলিতে মৃত্যুশয্যায়।খবরটা পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।কেঁদেও ছিলাম।ভালোভাবে জানার জন্য আরো কিছু তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করলাম এবং সেখানে যেই খবরটা পেলাম তাহলো রাজাকাররা তাকে গুলি করে তার বুক বিদীর্ণ করে দিয়েছিল।সেই রক্তাক্ত দেহ কে তার বোনের শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে সেই মুহূর্তে তাকে রক্ষা করা হয়েছিল।আজও আমার বন্ধু তাহের সেই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

মুক্তিযুদ্ধে সে সময়টা ছিল অত্যন্ত করুণ এবং বেদনাদায়ক।কোনভাবেই কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না কারণ কে যে পাকিস্তানিদের দালালি করছে সেই সময়টা হলফ করে বলা মুশকিল ছিল।কারন আশে পাশে কিছু রাজাকার ছিল ,যাদের কাজ ছিল কে মুক্তিযোদ্ধা , কে স্বাধীনতা বিশ্বাস করে , কে শেখ মুজিব এর নাম উচ্চারণ করে সেই সব খবর পাচার করা। সবাই বলতো কিছু বলবেন না দেওয়ালেরও কান আছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শোনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম , আমার চাচা এসে বলতেন রেডিওর আওয়াজটা কমিয়ে দাও কখন খাঁন সেনা বা রাজাকাররা এসে সবাইকে মেরে ফেলে! পুরো এলাকায় সম্বত আমাদের একটা রেডিও ছিল , কিনতু বিপর্যয় ঘটলো একদিন যখন ব্যাটারী কেনা যাচ্ছিলোনা , কারণ শহরে যাবে কে! অনেক কষ্ঠের পরে ব্যাটারী কেনা হলো। জীবনটাকে একটা অস্বাভাবিক মৃত নগরীর মতো মনে হতো। কী এক অজানা যন্ত্রণায় বুকটা টন টন করে ব্যথা করে উঠতো।

প্রতিদিন বিভিন্ন রকম খবর এর কারণে মনটা নিজের অজান্তে মানসিক রুগীর মতো মনে হতে থাকতো, যখন নিজের চোখে ঠিক ২০ফুট দূর থেকে দেখলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হাত, পা বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে রাজাকারেরা খরোস্রোতা খালে ফেলে দিলো। আমার মাথায় রক্ত উঠেগেল , মনে হচ্ছিলো যদি আমার কাছে একটা গ্রেনেড থাকতো আমি সেটি ছুড়ে মারতাম ঐ নরপিচাশ রাজাকার গুলোর মাথার উপর।

মুক্তি যুদ্ধের করুণ কাহিনি হয়তো অনেক বলা যাবে কিন্তু যাঁদের আত্মত্যাগে এই দেশটি স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রকৃত মুল্যায়নের সময় এসেছে !

তাই নজরুলের ভাষায় বলতে চাই ..

নম নম নমো বাংলাদেশ মম

চির-মনোরম চির মধুর।

এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে,

যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,

এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে

ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর॥

নিউ জার্সী, ডিসেম্বর ২০২৩। কবির কিরণ, সংগঠক ,সিইও ও আবৃত্তিকার , শতদল টিভি

শেয়ার করুন