নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

আড্ডা টেবিল তিনমাত্রার তোরণ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:৫৬ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:৫৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
আড্ডা টেবিল তিনমাত্রার তোরণ

সেদিনের আড্ডা ভেন্যু ছিল হিলসাইড এভেন্যু। আড্ডার ডায়াস বা মঞ্চ ছিল মান্নান রেস্তরাঁর বিবর্ণ টেবিল। আড্ডা টেবিলে ঝরেছিল কিছু সাহিত্যকথা, থেকে থেকে উঠেছিল দমকা বাতাসের মতো রাজনীতির তক্কোগপ্পো, যাকে বলে কফি কাপে কথার ঝড়। কুশীলব ছিলাম আমরা চারজনা — সাংবাদিক তাসের মাহমুদ, কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, ছড়াকার শাহ আলম দুলাল এবং আমি।

আড্ডার টেবিল একটা গেটওয়ে’র মতো মানে, একটা তোরণের মতো। সেই তোরণের ভিতর দিয়ে পাসিং শাওয়ারের মতো হুটহাট দু’একজন উড়ে আসে, কিছুক্ষণ থেকে উঠে যায়। ট্রেন স্টেশনের প্লাটফর্মে যেমন ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা ওঠানামা করে তেমনই চঞ্চল আড্ডার প্লাটফর্ম। তবে আড্ডার এই আপাতঃ চঞ্চলতার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে মঠের স্থিতধী।

আড্ডার তোরণ ত্রিমাত্রিক — বর্তমানের টেবিলে বসে আমরা একবার ফিরে যাই ফেলে আসা সময়ের সুখ ইউফোরিয়া আর আশাহত মিলাঙ্কোলিয়ায়। তাকাই হতাশাচোখ অনাগত দিনের দিকে। জীবনবৈরী যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসের কথা ভেবে বিচলিত হই। আদিগন্ত হিপোক্রেসি! একদিকে, একটি মৃত্যুর জন্য একটি দেশ, অনেক গুলো মহাদেশ বিচলিত হয়ে ওঠে। তারাই আবার একই সময়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে যুদ্ধের নামে রোজ হত্যা করতে থাকে।

যুদ্ধের মৃত্যু হয় না কখনো সে বুঝি অমর!

যুদ্ধের ক্রুর, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড, অকারণ মৃত্যুর গহন যাতনাযাপন মানুষকে বিপন্ন করে, প্রতিবাদী করে।

ইউরোপ, আমেরিকা থেকে একদল কবি, লেখক, অভিনেতা, সাংবাদিক ও চিত্রকর যুদ্ধের অর্থহীন বিপুল মৃত্যুর প্রতিবাদে চলে গিয়েছিল প্যারীতে। ইতিহাসে তাদের নাম, ‘লস্ট জেনারেশন’। সেই লস্ট জেনারেশনের লেখকরা প্যারীর পথে পথে ঘুরেছিল জীবনর খোঁজে। তাদের কথা ভাবতেই জেগে উঠি তীব্রতরুণ এক বোহেমিয়ান। পালাতে চাই রক্তপিপাসু যুদ্ধবাজ আর হিপোক্রেটিক মানুষের সন্নিধান ছেড়ে অলৌকিক কোনো অভয়ারণ্যে। বিপুলা এ আলয়, লোকালয় ছেড়ে জীবনটাকে রাখতে চাই স্রোতের মধ্যে এক টুকরো সবুজ জমিনে নতুন মানব। এমন মানব জনম আর কি হবে! না, হবে না, লালন সাই। এভাবেই কেটে যাবে জীবন এই dystopia নরকে।

আড্ডা মানে ‘টু অ্যান্ড ফ্রো’ — অতীতে ও ভবিষ্যতে যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা — শুধু ভাঙা ভাষা। আড্ডার প্রোটাগনিস্ট সে তো ‘সময়’। সময়ের যাওয়া আসা। ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড উপন্যাস পড়তে গিয়ে সময়কে একটা তোরণের মতো মনে হয়েছে। সময়কে এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট মনে হয়েছে। শুধুই পুরুষ বা নারী সব সময় একটা উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট হবে এমন কোনো কথা নেই। নদী, সমুদ্র, ঝড় হতে পারে না প্রোটাগনিস্ট?

এদিন পাসিং শাওয়ারের মতো আড্ডায় এসেছিল ‘কিউ জামান’।কথায় কথায় তিনি বললেন, আমেরিকায় আসাটা তার জন্য ভুল ছিল। কথাটার মধ্যে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত কবি শহীদ কাদরীর মনস্তাপ ঝরানো একটা কথার মিল আছে। স্বরচিত খোয়াড়ে আটক জীবন সায়াহ্ন দিনে কাদরী বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে আসা একটা হঠকারি সিদ্ধান্ত। হুইল চেয়ারে বসে আটলান্টিকের ঢেউয়ের ডগায় কবি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন নীলখামে তার শেষ কবিতা, চুম্বন গুলো পৌছে দাও। ডায়াসপরা কবির মতো একজন এক্সপ্যাট্রিয়ট কবির দোদুল্যমানতা একই দোলায় দোলে। পরদেশে মাধুকরী দিনের যাতনা বাদন বাজে অন্তরালে। এটা স্টেটলেছ কবির ডিলেমা।

কে হায় ছেড়ে যেতে চায় জন্মের ভূভাগ, চিরপ্রিয় মানুষের মুখ, স্মৃতির শহর। ওপড়ানো গাছের শেকড় চায় অঙ্কুরোদগমের মাটি, ফিরে পেতে চায় চিরচেনা মৃত্তিকার নির্যাস। যে জীবন উন্মূল শেকড়ের মতো সে হাঁটে এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল মানুষের মতো। সেই পা স্থিত হয় না কোথাও; তবুও যায় না ফিরে উৎসভুমির কাছে। ডায়াসপরা মানুষের এটা একটা শাশ্বতিক দিক। ডায়াসপরা আড্ডায় এটা পৌনঃপুন্য।

‘আড্ডা’ শব্দের ইংরিজি শব্দ হতে পারে কী ‘হ্যাঙ্গাউট’? না, মোটেই না; আড্ডার কোনো প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ হলে সেটা হবে আড্ডা। বড়জোর বলা চলে আড্ডাপালা। তবে, আড্ডায় যে কেউ মানানসই হয় না, হতে পারে না। আড্ডার প্রথম শর্ত হচ্ছে, আড্ডার কুশীলবকে আসনসহন হতে হবে মানে, আড্ডার চেয়ারে বা ঘাসের কার্পেটে ঘন্টার পর ঘন্টা স্বতঃস্ফূর্ত বসে থাকার শারীরিক সাচ্ছন্দ্য থাকতে হবে।

পথের কস্ট সইতে না পারলে যেমন সাধের প্রব্রজ্যা, ভ্রমণের মজাটা ভেস্তে যায়। কাঠের চেয়ারে হোক আর সোফা বা ঘাসের গালিচায় হোক, স্বাচ্ছন্দ্যে অনেক্ষণ বসে থাকতে না পারলে, গা গতরে সইতে না পারলে, আড্ডা গাড্ডায় পর্যবসিত হয়ে যায়। অপরিকল্পিত মাংসের স্তুপ শরীর আড্ডায় স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে না। ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত মানুষ যেমন ঘুমের জন্য টার্ন অ্যান্ড টুইস্ট করে রাত পার করে। ওবিইজ মানুষে তেমনি আড্ডার টেবিলে টার্ন অ্যান্ড টুইস্ট করতে থাকে। তারা দীর্ঘ আড্ডার মজাটা নিতে পারে না। তারা আড্ডার উষ্ণতা টের পায় না, আড্ডায় আগুন জ্বালাতেও পারে না। আড্ডা যে আড্ডাথন সেটা মোটা মানুষেরা বোঝে না। তারা আড্ডা টেবিলে বসতে না বসতেই উঠে যায় বোঝাই বিরানি খেতে রেস্তরাঁর টেবিলে। মোটা শব্দটা না বলে plump (প্লাম্প) বললে ভালো হতো।

সাহিত্যে এপিকিউরিয়ান চরিত্রের দেখা যায় উপন্যাসে এমনকি মার্কেজ এর উপন্যাসেও আছে। খাবারের জন্য আকুল (epicure) সব চরিত্র আছে তার অনেক উপন্যাসে। অস্বাস্থ্যকর খাবারে আসক্ত চরিত্র নির্মাণ করার একটা ঝোঁক ছিল মার্কেজের। উরসুলার মিল্ক ক্যান্ডির কথা আমরা জানি। অরেলিয়ানো সাগুন্দো তো খেতে খেতে প্রায় অক্কা পেয়ে গিয়েছিল ফুড কম্পিটিশনে।

নোটা বেনেঃ epicurean শব্দটি গ্রীকে দর্শনশাস্ত্রে এবং আমেরিকায় খাবারপেটুক অর্থে ব্যবহৃত হয়।

সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতা জানরায় শব্দের নেগেটিভ কনোটেশান আড়াল করা বা সঠিক জাত্যর্থের শব্দ ব্যবহার করা কবিদের জন্য সবচে জরুরি কাজ। কিছুদিন আগে একজন উঠতি কবির কবিতা পড়তে দিয়েছিলেন। কবিতাটি পড়তে গিয়ে থেমে যাই। তিনি একটি শব্দ লিখেছেন, প্রেমালু। তন্দ্রালু শব্দটির ব্যবহার সাচ্ছন্দ্য কিন্তু প্রেমালু?

প্রেম প্লাস (+) আলু। লে হালুয়া! সৈয়দ হকের মতো বলতে হয়, প্রেম শব্দটি যদি কাঁঠাল হতো আর বিয়ে শব্দটা হতো বাইসাইকেল — তাহলে কেমন লাগতো শুনতে!

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ, মায়েস্ত্রদের ক্লাসিক গান শেখার আগে এক আসনে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার চর্চা করতে হতো। সেটা সরগাম রেওয়াজের চাইতে কম কিছু না। স্বচ্ছন্দ বসতেই যদি না পারেন, মগ্নমন গান গাইবেন কী করে! বারবার টার্ন অ্যান্ড টুইস্ট করতে থাকলে আড্ডাটা দেবেন কীভাবে। আড্ডা তো গাড্ডায় গির যায়েগা। বলা হয়, obesity is devil — ওবিসিটি জীবনের সবখানে নিরানন্দ।

তাসের মাহমুদ এই পর্যায়ে ছড়া ও গানের ভুল ছন্দ সম্পর্কে একটা ভিজ্যুয়াল অবজার্ভেশন এর ছবি অভিনয় করে বর্ণনা করল। তার মতে ছড়ায় কোথাও মাত্রা কম হলে ছড়াকার ছড়াটি পড়বার সময় নিজের শরীরটাকে মাইম ভঙ্গীর মতো বাঁকিয়ে ককিয়ে উপরের দিকে টেনে তুলে লম্বা স্বরে উচ্চারণ করে। যেমন গানের লিরিকে মাত্রা কম হলে সুরকারের কেরামতিতে গায়ক দ্রুতলয়ে টেনে নিয়ে যায় আর মাত্রা বাড়তি হলে বাড়তি মাত্রাটাকে ঝট করে গিলে ফ্যালে। বর্ণনাটা হাসির হলেও ব্যাপারটা বোঝা ও বোঝানোর জন্য বেশ কার্যকর। প্লেটো কমেডিকে লোয়ার ক্লাস সাহিত্য বলেছেন। কবিতার prosody, poetics জানা পন্ডিতেরা লিরিসিস্টদের পুরো কবি বলতে নারাজ। তারা লিরিসিস্টদের হাফকবি স্বীকার করে বলেছেন গীতিকবি।

ছড়াকার কি তেমনি মাপে অর্ধকবি?

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ছড়াকার তাড়াহুড়া করে কবিতা লিখতে শুরু করে দিয়েছে। দু’একজন সফলও হয়েছেন। এমনকি বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছেন। ফিরে যাই মটুদের প্রসঙ্গে। খুব মোটা মানুষ আড্ডায়, আড্ডাথনে বিরক্তিকর হলেও ভালো গায়ক হতে পারে যেমন, নুসরাত ফতেহ আলী খান। তার ওজন ছিল ১৪০ কেজি বা ৩০০ পাউন্ড প্লাস। অন্যদিকে, সিরাজের ফৈজির ওজন ছিল মাত্র কুড়ি সের।

তবে কি জিরো-ফিগার এর শ্রেয়তা চিরকালের?

আমার সেটা মনে হয় না।

রেনেসাঁর নারীদের ছবি যেমন মোনালিসা এবং প্রি-রাফায়েলাইট জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ এর দ্য সোল অব দ্য রোজ ছবির নারী দেহবল্লরী জোয়ারের মতো ভরাট। আজও তাদের রূপ নরমরদ চোখে সুন্দর।

অতো দূরে যেতে হবে কেনো! হেফনার এর প্লেবয় ম্যাগ প্রথম সংখ্যা ১৯৫৩ সালে বিক্রি হয়েছিল ৫০,০০০ কপি। প্রচ্ছদে ছিল ম্যারিলিন মনরোর ছবি। মনরো জিরো-ফিগার ছিল না; ছিল মিড-ফিগার। অপরিকল্পিত মাংসের স্তুপ নারী শরীর নিয়ে পুরুষ কবি কোনো ‘Ode to Fat’ লিখেছেন কিনা জানি না। তবে একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ফিলি’র কবি ইলান ব্যস এর একটা কবিতা তুলে দিলাম যা তিনি লিখেছেন অপরিকল্পিত মাংসের স্তুপ নারী শরীর বন্দনা।

Ode to Fat

Tonight, as you undress, I watch your wondrous
flesh that’s swelled again, the way a river swells
when the ice relents. Sweet relief
just to regard the sheaves of your hips,
your boundless breasts and marshy belly.
I adore the acreage
of your thighs and praise the promising
planets of your ass.
O, you were lean that terrifying year
you were unraveling, as though you were returning
to the slender scrap of a girl I fell in love with.
But your skin was vacant, a ripped sack,
sugar spilling out and your bones insistent.
O praise the loyalty of the body
that labors to rebuild its palatial realm.
Bless butter. Bless brie.
Sanctify schmaltz. And cream and cashews.
Stoke the furnace
of the stomach and load the vessels. Darling,
drench yourself in opulent oil,
the lamp of your body glowing. May you always
flourish enormous and sumptuous,
be marbled with fat, a great vault that
I can enter, the cathedral where I pray.

কবি ইলান ব্যস যতোই স্থূল নারী শরীরের ওড ভার্স লেখেন না কেনো, কবিতাটিকে তিনি কিন্তু নির্মাণ করেছেন চর্বিহীন নিপুন কাব্যশরীর। সব শরীর সুঠাম, ঋজু হলেই যে তা আড্ডার জন্য ব্যাপক অভিনিবেশযোগ্য হবে এমন কোনো অনিবার্যতা নেই। তবে কাব্যশরীরে অপরিকল্পিত মাংসের উত্থানের মতো চর্বির স্তুপ জমলে অবশ্যই কবিতা হয়ে পড়বে ব্যাধিমন্দির। নিউ ইয়র্ক অক্টোবর ২০২৩

শেয়ার করুন