নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুসা আল হাফিজ

সাহিত্যে নোবেলজয়ী ইয়ন ফসের মনোগঠন ও সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র্য

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩ | ০৮:২৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩ | ০৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
সাহিত্যে নোবেলজয়ী ইয়ন ফসের মনোগঠন ও সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র্য

ইয়ন ফসের রচনা মানে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন এবং মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ কার্যকারিতা নিয়ে ছোট ছোট নদীতরঙ্গের বিস্তার।

ইয়ন ফসে নোবেল পেয়েছেন, অবাক করেনি খবরটি। সমসাময়িক দুনিয়ার সবচেয়ে মেধাবী ১০০ মানুষের একজন হিসেবে স্বীকৃত তিনি। তার সেপটোলজি ট্রিলজির তৃতীয় খণ্ডটি ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। ৪০টি অনবদ্য নাটক লিখেছেন ফসে।

উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুদের বই আর অনুবাদের সম্পদে সমৃদ্ধ তার জগত। তিনি যা নিয়ে কাজ করেছেন, সবখানেই থেকেছেন উদ্দীপক, রহস্যময় ও জনপ্রিয়। কথাশিল্প ও নাটকে তার কৃতিত্ব শুধু বিশিষ্ট নয় বরং চমকপ্রদ।

সেপটোলজি সিরিজের উপন্যাস, অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার, মেলাঙ্কলি, অ্যা শাইনিং প্রভৃতি তার সেই অনবদ্যতাকে ব্যাখ্যা করে।

সাহিত্যে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসন বলেছেন, ‘ফসে আধুনিকতার পরিপ্রেক্ষিতে শৈল্পিক কৌশলের সঙ্গে তার নরওয়েজিয়ান পটভূমির ভাষা এবং প্রকৃতিতে একাকার করেছেন। সেটা করেছেন এক ভিত্তিভূমি ও শেকড়ের সহযোগে।’

ওলসনের মতে, নোবেল কমিটি ফসের ‘গীতিমূলক তীব্রতা’ এবং ‘মনের জগতে নতুন স্থান উন্মুক্ত করার’ ক্ষমতাকে উদযাপন করতে চেয়েছে।

রয়েল সুইডিশ একাডেমি জানিয়েছে, তাকে নোবেল দেওয়ার মূলে আছে ‘নির্বাককে কণ্ঠ দেওয়ার উদ্ভাবনী নাটক এবং গদ্য’। তিনি তার নাটক এবং গদ্যের মাধ্যমে সেই সব মানুষের ভাষা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যারা কথা বলতে অক্ষম।’

ফসে ক্যাথলিক মতবাদে দীক্ষিত হন ২০১৩ সালে। সমুদ্রতীরের একাকী জীবন, নিঃসঙ্গতা, মাদক ইত্যাদির মধ্যে চলমান ছিল তার মানসিক ভাঙা-গড়া।

তার জন্ম ১৯৫৯ সালে, নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে হাউজসুন্ডে, বেড়ে ওঠেন স্ট্র্যান্ডেবার্মে। সাত বছর বয়সে একটি দুর্ঘটনা ঘটে তার জীবনে। মারাই যেতে বসেছিলেন। ওই ঘটনাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা।

ফসের মতে, ওই দুর্ঘটনা তার শিল্পীসত্তাকে সৃষ্টি করেছে।

কৈশোরে অবশ্য তিনি চাইতেন, রক গিটারিস্ট হবেন। কিন্তু অচিরেই তার কলম গান গাইতে শুরু করে, বাজতে থাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কবিতা দিয়ে শুরু হয় সাহিত্যযাত্রা।

তার প্রথম উপন্যাস, Raudt, svart (রেড, ব্ল্যাক) প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। উপন্যাসটি আত্মহত্যাকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল। সেখানে ছিল এক রহস্যময় নারীর প্রতি আচ্ছন্ন এক যুবকের ভাঙন। উপন্যাসটিতে মূলত ফসের নিজস্ব স্মৃতির ছায়া কাজ করেছে।

আর তার পরের সাহিত্যকর্মে রয়েছে ‘রেড ব্ল্যাক’ উপন্যাসের ছায়া ও সম্প্রসারণ। যদিও প্রথম উপন্যাসটি শিল্পসাফল্য অর্জন করতে পারেনি তেমন।

তার অভিনীত প্রথম নাটক Og aldri skal vi skiljast (And Never Shall We Part) মঞ্চস্থ হয়েছিল বার্গেনের ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৯৯৪ সালে।

তার নাটকসত্তা বড় অর্থে পাদপ্রদীপের আলোয় আসে Nokon kjem til å komme (কেউ কেউ আসছেন) এর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে নান্টেরেতে এই নাটক মঞ্চস্থ করেন ফরাসি পরিচালক ক্লদ রেজি।

১৯৮৯ সালে যখন ফসের ‘নস্টেট’ (বোটহাউস) প্রকাশিত হয়, তখনই কথাশিল্পে তার সুরের স্বাতন্ত্র্য আপন আমেজে আমোদিত করে বোদ্ধাদের। তখনই স্বীকৃত হয়, ফসে যা কিছু লেখেন তাতে তার কণ্ঠস্বর দ্ব্যর্থহীন।

ফসে লেখালেখি করেন নরওয়ের সংখ্যালঘু ভাষা, নরস্ক বা নিউ নরওয়েজিয়ান ভাষায়। তার ভাষা ও কাজ রাজনৈতিক আবহাওয়ায় শিহরিত, যা তার পরিচয়ের নিজস্বতাকে উচ্চকিত করতে অকুণ্ঠ।

ইয়ন ফসের রচনা মানে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন এবং মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ কার্যকারিতা নিয়ে ছোট ছোট নদীতরঙ্গের বিস্তার, যাকে বুঝতে হলে তার অনবদ্য কাজ ‘সেপটোলজি’র মুখোমুখি হতে হবে।

এছাড়া, ‘দ্য নেম’, ‘দ্য আদার নেম’ এবং ‘আই ইজ অ্যানাদার’ নিয়ে ট্রিলজি তার সাহিত্য জীবনের এক ভিত্তি। এটি অ্যাসলে নামে এক লেখকের জীবন, যা তার পরিচয় ও অস্তিত্বের চিন্তাভাবনার মগ্নচিত্তের কাহিনী বলে যায়।

নিউ নেইম’ জন ফসের অন্যতম সিগনেচারধর্মী কাজ। এর প্রকৃত নাম ‘Eit nytt namn’, প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। উপন্যাসটি পরিচয়, স্মৃতি এবং সময়ের ব্যবধানের ধারণাগুলোকে রহস্যময় ভাষা দেয়৷ এ গ্রন্থে ফসে তার চরিত্রগুলোর নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং আবেগের ওপর দৃষ্টিপাত করেন। যা তার অন্তর্নিদর্শন এবং ধ্যানশীল প্রকৃতিকে গতি দিয়েছে।

এই রহস্যময়তার মধ্যেও ‘নিউ নেইমের’ নায়ক নিজের ও নিজেদের অতীত এবং নিজস্ব পরিচয়ের তাৎপর্য নিয়ে মগ্ন থাকে। এ বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে জীবনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘সেপটোলজি’ উপন্যাস জন ফসের ৭ খণ্ডের এক সিরিজ। প্রতিটি ভলিউমে আছে একই গল্পের ভিন্ন ভিন্ন শাখার উন্মোচন। যার মাধ্যমে মানবচরিত্রের বিভিন্ন দিককে অন্বেষণ করা হয়েছে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

সাতটি খণ্ডের শিরোনাম হলো ‘Andvake’ (২০০৭), ‘Olavs draumar’ (২০০৮), ‘Kveldsvævd’ (২০০৯), ‘Eit vinterland’ (২০১০), ‘Nattauka’ (২০১১), ‘Sveve over vatna’ (২০১২) এবং ‘Det er Ales’ (২০১৩)।

এই সিরিজ ফসের উদ্ভাবনী গল্প বলার ঢং এবং সাহিত্য শৈলীর আনকোরা বর্ণিলতার জন্য সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে।

ফসের সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে ৪০টির বেশি ভাষায়। বিশ্বব্যাপী তার লেখা এবং চিন্তা সমাদৃত হচ্ছে অনন্য শৈলী, আত্মদর্শন এবং মৌলিক মানব অভিজ্ঞতার অন্বেষণের জন্য।

তার লেখার শৈলী সংক্ষিপ্ত, খণ্ডিত বাক্য কাব্যিক ঘোরের মধ্য দিয়ে গতিশীল। ঘটনাসমূহ তন্ময়তার মধ্য দিয়ে পাঠককে অধিগ্রহণ করে। অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা এবং আবেগের ওপর তার সংবেদী দৃষ্টি। তার কাজের মধ্যে থাকে স্বপ্নের মতো গুণ, যা বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে ঝাপসা সেতু তৈরি করে।

তার নাটক বিক্ষিপ্ত সংলাপ এবং দূরান্বয়ী সংযোগে সুশৃঙ্খল, যা অন্তরঙ্গতা এবং আত্মদর্শনের অনুভূতি তৈরি করে। ফসে তার ‘Melancholy’ উপন্যাসে একজন মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ কাজগুলোকে অন্বেষণ করেছেন, যখন সে মানসিক অসুস্থতা এবং নিজের সন্ধানের সাথে তুমুল লড়াই করছে।

ফসের থিমগুলো মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক দিকগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয়। রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে ঈর্ষা এবং প্যারানিয়ার প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে। তিনি মানবসম্পর্কের জটিলতা, সময়ের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি, অর্থের সন্ধান এবং মৃত্যুর অনিবার্যতা অনুসন্ধান করেন।

অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং জীবন ও মৃত্যুর রহস্য নিয়ে মগ্নতা ফসের ভাষা তৈরি করেছে। বিষয়ের এই জটিলতা সত্ত্বেও তার কাজগুলোকে পণ্ডিত এবং পাঠকরা একাধারে অধ্যয়ন করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন।

শেয়ার করুন