নিউইয়র্ক     শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এইচ বি রিতা

রশেল-উন্মাদ রশেল

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:১৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
রশেল-উন্মাদ রশেল

সুন্দর, শান্ত এবং পরিবেশ বান্ধব একটি শহর ছিল পৃথিবীর কোথাও কোনো একদিন যেখানে মানুষের শহুরে জীবনযাপন প্রকৃতির সাথে সুরেলাভাবে সহাবস্থান করতো। শহরটির সবুজে ঘেরা পার্ক আর উদ্যান বাসিন্দাদের প্রকৃতির সাথে সংযোগ করাতো। এই সবুজে ঘেরা স্থানগুলি শহরের বায়ুর জন্য প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসাবে কাজ করতো, সম্প্রদায়ের মাঝে সৌহার্দ সম্প্রীতি আর সংস্কৃতির ঐতিয্য বহাল রাখা ছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে। এ যেন শহর নয়, শান্তিময় এক প্রাসাদ।

সেবারটা ছিল শরৎকাল। শরৎতের উষ্ণতা ও মৃদু বাতাসের সংমিশ্রণে প্রকৃতির গাছ, ডাল পালা যেন কিশোরীর কোমরে বাঁধা রুপার বিছার মতো ছন্দ তুলে হেলেদুলে দুলছিল। অপার বিস্ময় নিয়ে আকাশ মাতৃস্নেহে ধরে ছিল খণ্ড খণ্ড মেঘ, মেঘেদের খুনসুটি।

এমনই এক উষ্ণশীতল শরৎতের রাতে, সেই শান্ত শহরে উদয় হলো রশেল নামের এক ব্যক্তির। মুখে থাকতো তার মৃদু হাসি, তবে সে হাসি তার চোখের কাছে কখনো পৌঁছাতো না। কেমন যেন মৃত, চ্যাপ্টা সরীসৃপের মতো প্রাণহীণ চোখ। এ চোখে কোন অন্তর্নিহিত ব্যক্তিত্বের সংকেত থাকতে পারে, এমনটা কেউ বুঝতেই পারেনি। সে সর্বদা অনবদ্য পোশাক পরে থাকতো আর স্বভাবে ছিলেন ভদ্র। খুব অল্প সময়েই সকলের কাছে সে পরিচিত হয়ে উঠল একটি গ্রোসারি স্টোরের হিসাবরক্ষক হিসাবে। কিন্তু এই মুখোশের পিছনে, লুকিয়ে ছিল রশেলের একটি অশুভ রহস্য।

শৈশবে, রশেল ছিল অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যধারী একটি শিশু। তার সহানুভূতির অভাব ছিল। ছোট প্রাণীদের বেদনায় আনন্দিত হতো সে। ছোট ছোট খেলনাগুলিকে সে প্রায় সময়

ভেঙ্গে ফেলতো মজার ছলে। নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করতো সে নিজ দাদিকে। হুটহাট মেজাজ বদলে গেলে না খেয়ে থাকত। চিৎকার করতো। তার বাবা-মা ছেলের মধ্যে অন্ধকারের সে ছায়া দেখতে পাননি, তারা ছিলেন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, ছেলের প্রতি অমনোযোগী। আর তাই তার আচরণকে নিছক শৈশব কৌতূহল বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মূলত এভাবেই রশেল বেড়ে উঠে। রশেলের বড় হওয়ার সাথে সাথে তার আসল প্রকৃতি লুকিয়ে রাখতে সে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। রশেল নানাভাবে শিখে যায় কীভাবে আবেগকে অনুকরণ করতে হয়, ভেতরের অদ্ভুত সত্তাকে লুকিয়ে সমাজে নির্বিঘ্নে মিশে যেতে হয়। আর তাই তার পলিশ করা ব্যহ্যাবরণের নিচে লুকিয়ে থাকা দৈত্যকে কেউ সন্দেহ করেনি।

রশেল তার অফিসে পরিশ্রমের সাথে কাজ করতে থাকে। দিনে দিনে তার সহকর্মীদের সম্মান এবং বিশ্বাস অর্জন করতে থাকে। কাজের পর সে ইন্টারনেট, ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করতো, শোষণের জন্য দুর্বল কিংবা শান্ত স্বভাবের ব্যক্তিদের সন্ধান করতো। অনেকটা পুতুল খেলার মতো নিজের বিনোদনের জন্য মানুষের আবেগকে কাজে লাগাতে শুরু করে সে। এরই মাঝে কমিউটিটিতে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে লেখক হিসাবেও একটা ভালো পরিচিতি অর্জন করে নেয় রশেল। তার মধ্যে একটা সুপারফিশিয়াল ক্ষমতা ছিল, যা অন্যদের আকর্ষণ করত সহজেই। নিজ প্রয়োজনে সে অন্যদের ম্যানিপুলেট করতে শুরু করে।

সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে অন্যের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য রশেলের অতৃপ্ত তৃষ্ণা বাড়তে থাকে।নিজ ভাবনাকে সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য করে তুলতে আবেগপ্রবণতা বাড়তে থাকে। সেই সাথে সহানুভূতির অভাব আরও তীব্র হয়, যা তাকে অন্যদের সাথে গভীর মানসিক সংযোগ তৈরি করতে কঠিন করে তোলে। তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তির জন্য তার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। কর্মের ফলাফল চিন্তা না করেই দিন দিন সে বেপরোয়া আচরণের জন্ম দিতে থাকে, যা অন্যের জীবনকে একসনয় বিপন্ন করে তোলে। তবে সে জানতো না যে, তারও একটি দুর্বলতাও রয়েছে, যা তাকে অন্যদের সাথে গভীর, সৌহার্দপূর্ণ সংযোগ ও সম্পর্ক বজায় রাখাতে বাধা তৈরি করছিল।

একসময় শহরের একজন মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, নাম এলিজা তার এই গুপ্ত হিংস্রতার শিকার হোন। রশেল একটি দল তৈরি করে এলিজাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে। তবে রশেল খুব চতুর, সরাসরি নিজেকে প্রকাশ করতো না। তাছাড়া অন্যকে ম্যানুপিউলেট করার ক্ষমতা তার বেশ, তাই কমিউনিটির অনেকেই তার এই অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করলেও তাকে কিছু বলতো না। তবে, এলিজা তাকে এভাবে ছেড়ে দেয়নি। এলিজা দিনদিন তার উপর নজর রাখতে শুরু করে। তার আচরণগুলো নিয়ে গবেষণা করতে থাকে। একসময় এলিজা বুঝতে পারে, অন্যদের উপর ক্ষমতা ধরে রেখে রশেল বেশ উপভোগ করে। অনেকটা অর্কেস্ট্রা পরিচালনাকারী উস্তাদের মতোই সে তার আবেগকে অন্যদের উপর চালিত করতে পছন্দ করে। এলিজা লক্ষ্য করে, অন্যদেরকে হতাশার অতল গহ্বরে ঠেলে দিয়ে রশেল তাদের কষ্টের প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ খুঁজে পায়।আশেপাশের লোকদের জীবন নিয়ে খেলা যেন তার কাছে পুতুল নাচের মতোই কিছু। আর সেই খেলা খেলতে সে আশেপাশের নির্দিষ্ট কিছু লোকদের দুর্বলতাগুলিকে কাজে লাগানোর উপায় সন্ধান করে।

যাইহোক, অশুভ ছায়ার রাজত্ব চিরতরে ঠিকে না। দিনদিন রশেলের আচরণবিধি নজরে রেখে একসময় এলিজা তার প্রখর অন্তর্দৃষ্টির সাথে হয়ে উঠে একজন তদন্তকারী। রশেলের হিংস্রতার শিকার হওয়া শহরের ‌অনন্যদের সাথে এলিজা কথা বলতে থাকে। জানতে পারে তার আরো নানা ‌অস্বাভিক কাজের কথা। আর তখনই রহস্যময় রশেলের আচরণগুলো একত্রিত করতে শুরু করে সে। আর সেটাই তাকে রশেলের লুকানো দ্বৈতসত্তার দিকে নিয়ে যায়। রশেলের মনোমুগ্ধকর বহির্ভাগের নিচে থাকা আরেক অন্ধকার জগতকে এলিজা খুঁজে পায় যেখানে তার জেগে থাকা ভাঙা শৈশব ও জীবনের মধ্যকার ক্ষত ও বিন্দুগুলিকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয় সে।

একদিন এলিজা তার সাইক্রিয়াটিস্ট বন্ধু মিশ্যালের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করে। রশেলের সমস্ত কার্যবিধি সম্পর্কে জেনে মিশ্যাল জানায়, সম্ভবত সে একাধিক মানসিক সঙ্কটে রয়েছে যার সারমর্ম হতে পারে সাইকোপ্যাথির জটিল একটি অবস্থা। এলিজা যদিও রশেল সম্পর্কে এমনই ভেবেছিল, তবু সে বন্ধুর মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত করতে চাইছিল। এবং বেশ ভাবনায় পড়ে যায়। কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় রশেলের কাছ থেকে-তাই ভাবতে থাকে। কারণ রশেল কেবল এলিজাকেই টার্গেট করছিল না, তার সহকর্মী বন্ধুদেরও নানাভাবে হয়রান করছিল। তাছাড়া ইতোমধ্যেই তার বুদ্ধিমত্তার মুখোশের আড়ালের অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে অনেকেই জানতে পেরেছিল। তার ভিতরের দৈত্যটি সম্পর্কে গ্রোসারি স্টোরের মালিকও জেনে যায় এবং রশেলকে চাকরিচ্যুত করে। সে অবস্থা রশেলকে আরো উগ্র করে তোলে। তবে, বেশিদিন রশেল সে শহরে থাকতে পারেনি, চাকরিচ্যুত হবার কয়েক মাস পরেই সে শহর ছেড়ে চলে যায় অন্য শহরে। শহরের অনেকেই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেল তার বিদায়ে। প্সুন্দর, শান্ত এবং পরিবেশ বান্ধব শহরটি যেন পুনরায় ফিরে পেল নিজ লাবন্য।

প্রায় পাঁচ বছর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সময়ের সাথে শহুরে মানুষও ভুলে গেল রশেলকে। এদিকে এলিজা তার মাস্টার্স সম্পন্ন করে হয়ে উঠল একজন মেন্টাল হেল্থ কাউনসিলর। জীবন চলছিল জীবনের নিজ গতিতে।

একদিন ছুটির ভোরে হঠাৎ করেই শহরের এক নামিদামী পত্রিকায় চোখ আটকে গেল এলিজার। শিরোনামে বড়ো করে লেখা “A 55 year-old man drinks Lysol to end life!” এলিজার চোখ আতঙ্কে যেন টাসিয়াসের মতো স্থির হয়ে গেল। লাইজল পান করে আত্মহত্যা! পুরো সংবাদ পড়ে এলিজা বিড়বিড় করতে থাকে-এ কী! এ তো সে-ই রশেল! রশেল-উন্মাদ রশেল!

হঠাৎ করেই এলিকার মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। এলিজা বুঝতে পারল না, রশেলের জন্য তার মনে মেঘ ঘন হচ্ছে নাকি তার লেখা শেষ চিঠিটির জন্য। সেই খবরে আত্মহত্যার আগে রশেলের একটি চিঠি যুক্ত করা হয়েছিল। চিঠিতে রশেল লিখেছিল,

“টের পাচ্ছি, বেশ কিছুদিন যাবত অস্বস্তিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বিদায় নেবার সময় এসেছে। ভয়ানক এক সুপ্ত জ্বালাময়ী শিকড় গজিয়েছে ভিতরে বহুদিন, দিনরাত কেবল শুষে নিচ্ছে বেঁচে থাকার সকল উপকরণ! বেঁচে থাকা নিরর্থক হয়ে উঠছে। রোজকার মতো একি নিয়মে সকাল হতে রাত অবধি ছুটে চলা, একই নিয়মে মিথ্যার বুলি, হেসে খুন, সমঝোতা; উল্লাস-কেন করছি এসব? ভেবে পাচ্ছি না। রোজ জাগতিক নিয়মের বলি হতে আর ভাল লাগছে না।

ফিরে যাচ্ছি পিছনে বার বার! সেই সময় সেই পাড় ভাঙ্গা নদী মনে করিয়ে দিচ্ছে আমায় প্রতিদিন একবার করে ভাঙ্গনের কথা! ভাঙ্গা গড়ার খেলায় আমি এক শিশু, হাতজোর করে কাঁদতাম। বলতাম, শোনছ? ব্যথা হয়! খুব ব্যথা! কেউ শুনতো না। হাতুরীর শব্দে ঠকঠক করে কষ্ট, কেবল আমাকে আচ্ছন্ন করে যেতো। মনে হতো কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু পালাবার জায়গা ছিল না। তখন আমার মা’কে ভীষণ মনে পড়ত। বিড়বিড় করে বললাম, মা! কেন থেকে গেলে না আমার সাথে?

কৈশোরে পা রাখলাম, একদম একা। ভয় আমাকে তাড়া করতো। কিসের তাড়া, জানা নেই। কখনো কখনো নিজের ছায়া দেখেও চমকে উঠতাম। দূরে কোথাও গান বেজে উঠলে, অস্থির লাগতো, পাখির ডাক কানে জ্বালা ধরাতো। কোলাহল ছেড়ে নদীর পাড়ে বসে থাকতাম। ওখানেই নিজেকে নিরাপদ মনে হতো। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে মনে হতো, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। টুপটুপ করে মগজ গলে পড়ছে মাটিতে। মাথায় হাত চেপে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়তাম। চিৎকার করতাম। কেউ শুনতো না। হামাগুড়ি দিতে দিতে ঈশ্বরকে ডাকতাম, হে ঈশ্বর! আমার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমার মগজ গলে পড়ছে! কষ্ট হচ্ছে! কষ্ট! কিন্তু ঈশ্বরের কানে আমার চিৎকার কখনো পৌঁছাইনি।

দিন দিন মানুষগুলো আমার কাছে হয়ে উঠছিল অসহনীয়। তাদের উল্লাস, আনন্দ, অসহ্য লাগতো। ভালবাসার ফুলগুলো ভুল মনে হতো। কারো চোখে প্রণয় দেখলেই ভয় জাগতো মনে। মনে হতো, ওই চোখ শুষে নিচ্ছে আমার সবটা। আগেও দেখেছি বহুবার ওই চোখ, রক্তপিঙ্গল চোখে আমাকে খুন করা হয়েছে অসংখ্যবার। চট করেই মাথার যন্ত্রনা শুরু হতো, যেন ইট পাথরে কেউ মাথাটা থেঁতলে দিচ্ছে। মনে হতো ঘার হতে মাথাটা কেটে হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলি দূরে।

আজ লাইজল আমার শিরা উপশিরাগুলো নিস্তেজ করে দিচ্ছে। আমি বিদায় নিচ্ছি। এ এক ভয়ানক অনুভূতি। আজ যেতে যেতে পিছন ফিরছি, কিন্তু কারো জন্য মায়া হচ্ছে না। অনুশোচনা হচ্ছে না। কি অদ্ভুত! মৃত্যুবেদনাও আমাকে পৃথিবীর প্রতি অনাসক্ত করে তুলছে। একদিন থেকে যাওয়ার আসক্তিতে কতই না আকাঙ্ক্ষার জারজ বীজ বুনে ছিলাম পৃথিবীর বুকে!

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখা হয়নি। মৃত্যু এক ঘুটঘুটে অন্ধকার, এক রহস্য যা এতদিন আমার খোঁজে ঘরের কোনে কোথাও মুখ বুজে পড়েছিল। আজ মনে হচ্ছে, মৃত্যুর মধ্যদিয়ে মুক্তির পথের দেখা পাচ্ছি। শূন্যে তলিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ছে, কতদিন আমি ঘুমুইনি। কত রাত কেবল ছটফট করে কাটিয়েছি। আজ ঘুমানোর সময় এসেছে। আজ মস্তিষ্কে কারো আনন্দের ঝলক দেখে থাবা দেবার হিংস্রতা নেই। কোন অনুভুতি নেই, কোন রক্তক্ষরণ নেই। আজ আমার শুধু ঘুমানোর তাড়া।” নিউ ইয়র্ক নভেম্বর ২০২৩

শেয়ার করুন