নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

টাইম ম্যাগাজিনে বাংলাদেশের জন্মগাথা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
টাইম ম্যাগাজিনে বাংলাদেশের জন্মগাথা

শিশির কুমার নাথ: নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের প্রায় সমস্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বিজয়ের সংবাদ। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ‘টাইম’ ম্যাগাজিন করেছিল প্রচ্ছদ আয়োজন। যুদ্ধপরবর্তী সেই সময়কার কথামালা নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের আয়োজন নিয়ে…

অস্ত্র হাতে মুখে বিজয়ের স্লোগান। এমনই এক গেরিলা যোদ্ধার জয়োল্লাসের ছবি প্রচ্ছদপটে। সঙ্গে যথোপযুক্ত শিরোনাম The Bloody Birth Of Bangladesh. এভাবেই নতুন বাংলাদেশের বিজয়গাথা বিশ্ববাসীকে জানায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর-পরবর্তী সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ‘বাংলাদেশ : যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’ শিরোনাম দিয়ে প্রতিবেদনটি শুরু হয় এভাবে : ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! গঙ্গা থেকে বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র, রত্নতুল্য ধানক্ষেত থেকে গ্রামের সরিষা রঙের পাহাড়, অগণিত গ্রামের অগণিত প্রান্তর থেকে ডাক উঠেছে বাংলার জয়! বাংলার জয়! তারা বাসের ছাদের ওপর নৃত্য করছিল এবং সোনার বাংলা গাইতে গাইতে জনতার ঢল নেমেছে শহরের পথে। তারা সব ভবন থেকে গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে বাংলার সবুজ, লাল ও সোনালি রঙের ব্যানার ওড়াচ্ছিল, তাদের কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও উড়ছিলো। ভারতীয় বাহিনী প্রথমে যশোর, তারপর কুমিল্লা হয়ে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী বাঙালি তাদের অভিবাদন জানাচ্ছে।

এভাবে গত সপ্তাহে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক নতুন জাতির জন্ম হয়েছে।’

প্রতিবেদনটির ইংরেজি বর্ণনা ছিল এরকম : ‘JAI Bangla! Jai Bangla!’ From the banks of the great Ganges and the broad Brahmaputra, from the emerald rice fields and mustard-colored hills of the countryside, from the countless squares of countless villages came the cry. ‘Victory to Bengal! Victory to Bengal!’ They danced on the roofs of buses and marched down city streets singing their anthem Golden Bengal. They brought the green, red and gold banner of Bengal out of secret hiding places to flutter freely from buildings, while huge pictures of their imprisoned leader, Sheik Mujibur Rahman, sprang up overnight on trucks, houses and signposts. As Indian troops advanced first to Jessore, then to Comilla, then to the outskirts of the capital of Dacca, small children clambered over their trucks and Bengalis everywhere cheered and greeted the soldiers as liberators.

Thus last week, amid a war that still raged on,the new Nation of Bangladesh was born. (Time, December 20, 1971)

এমন কাব্যিক বর্ণনায় উঠে আসে রক্তস্নাত বাংলাদেশের কথা। প্রতিবেদনটিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংকট আলোচিত হয়েছে নানাভাবে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশকে ভারত ও ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় শুরুর দিকে। ইন্দিরা গান্ধীর পার্লামেন্টারি বক্তব্যের দিকও তুলে ধরা হয় গুরুত্বের সঙ্গে। একটি ছবিতে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে বাঙালির বিজয়োল্লাসের দৃশ্য জয়গর্ব প্রকাশ করে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোকচিত্রের মাধ্যমে যুদ্ধাবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি সংকট এড়াতে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রতিবেদকের কলম ফাঁকি দিতে পারেনি। The UN did its best to stop the war, but its best was not nearly good enough. এ কথাতেই বিষয়টি স্পষ্ট। বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথা লেখা হয় এভাবে : ‘বাঙালি পাকিস্তানের প্রথম দেশব্যাপী অবাধ নির্বাচনে ভোট দেয় তাদের নেতা মুজিবকে বিজয়ী করতে। কিন্তু তা নৃশংসভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে শেষ হয়ে যায়। সেই আঘাতে সম্ভবত ১০০০০০০ মানুষ মারা যায় ও ১০ মিলিয়ন শরণার্থী অন্য দেশে চলে যায়। আর হাজার হাজার অবর্ণনীয় গৃহহীন ক্ষুধার্ত এবং অসুস্থ মানুষ পড়ে থাকে।’

ভুট্টোকে (জুলফিকার আলী ভুট্টো) একজন ঘৃণ্য রাজনীতিবিদ উল্লেখ করে বলা হয়, যিনি ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করে নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে সরিয়ে রাখতে সফল হয়েছেন।

একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিও জোরালো ছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের শূন্যতার বিষয়টি উপলব্ধি করে লেখা হয়েছে, ‘ইয়াহিয়া কি মুজিবকে মুক্তি দেবেন? সেই জাদুকরী নেতা যিনি দেশভাগের পর থেকে বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।’

মনোবলহীন ও ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনাদলের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের চিত্রটি কেমন ছিল সেদিন, তা জানানো হয় বিশ্ববাসীকে। পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী জেনারেল স্যাম মানেকশ’র নির্দেশ ছিল এমন : ‘তোমরা আমার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে যদি পালানোর চেষ্টা করো, তাহলে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি তোমাদের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে।’

তিনি আরও বলেন, আত্মসমর্পণ করলে তাদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা হবে। নতুন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল হলেও সে সব দেশের ৫০% অবদান রেখেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ৭০% আয় তাদের। কিন্তু বিনিময়ে শুধু অল্প শতাংশ পেয়েছে।’

তৎকালীন মার্কিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও দেশটির বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পীসমাজ ও সংবাদপত্রগুলো ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যা ও শরণার্থী ইস্যুতে দেশটির সাধারণ মানুষ সোচ্চার ছিল। সে দেশের সংবাদমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও নিক্সন প্রশাসনের সমালোচনা ছিল মার্কিন নীতির ওপর চপেটাঘাত। ওই প্রতিবেদনেও উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়।

এভাবে অক্ষরে অক্ষরে উঠে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির কথা, ছাপা হয় লাঞ্ছিত মানুষের জয়জয়কারের চিত্র। নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটি ছিল এমন : ‘মানব ইতিহাস ধৈর্য অপেক্ষা করছে অপমানিত মানুষের জয়জয়কার দেখার জন্য।’ সেখানে আরও বলা হয়, ‘উত্থান হয়েছে- তবে অনেক দামের বিনিময়ে। উপমহাদেশের যুদ্ধ এবং নতুন জন্মগ্রহণকারী হাড়ফাটা দারিদ্র্যের দেশ- বাংলাদেশের বিজয় দুঃখপূর্ণ।’

আধুনিক সমরবিজ্ঞানের মতে, যুদ্ধের একটি বড় অংশ প্রকৃতার্থে গণমাধ্যমেই সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সরব ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা সাধারণজন থেকে শুরু করে সামরিক অফিসারদের বয়ান সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলো প্রকাশ করেছেন নির্দ্বিধায়। পাকিস্তানি সৈনিকদের নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতনের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্রগুলো শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের টাইম সাময়িকীর এ সংখ্যাটিও ইতিহাসের দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। তাই মহান বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেসব সংবাদযোদ্ধাকে, যারা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে এসব চিত্র তুলে এনেছিলেন।

শেয়ার করুন