নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবু সাঈদ তুলু

সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্মগুলো মূলত একটা শিক্ষা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:২৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্মগুলো মূলত একটা শিক্ষা

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য-সংস্কৃতির জাগরণমূলক আন্দোলনে সেলিম আল দীনের ভূমিকা অপরিসীম। যেহেতু বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র, অতএব জাতিগত আত্মপরিচয় জরুরি। আর আত্মপরিচয় সৃষ্টিতে সেলিম আল দীনের কর্মগুলো পথের দিশারি। সেলিম আল দীন নাট্যকার হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও সাহিত্যের নানা শাখাতেই তার ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস রচনা করলেও নাটককেই তিনি বেশি আঁকড়ে ছিলেন। তার নাট্য-সাহিত্য-সংস্কৃতি ভাবনা মূলত এগিয়েছে উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির হাজার বছরের জারিত রসের পরম্পরার আদর্শে।

কবিতায় রেঁবো-বোদলেয়ার দ্বারা বুদ্ধদেব, নাটকে প্রসিনিয়াম ধারা, উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কট প্রভাবে বঙ্কিমের আদর্শ যে আধুনিকতার সূচনা করেছিল তা ছদ্মবেশে অনেকাংশেই গ্রাস করেছিল আমাদের অতীত। ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের প্রভাব মাথার ওপর দোর্দণ্ড মার্তণ্ডের মতো হয়ে উঠছিল। ধীরে ধীরে দুশ বছরে বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুকৃতি বা অন্ধ অনুকরণ। আধুনিকতার ধুয়া তুলে অনেকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুশাসন পালনেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাঙালির সহস্র বছরের ধারাবাহিকতায় উৎপন্ন আমাদের নিজস্ব শিল্পরীতির সঙ্গে তা চিরবিচ্ছেদের পালা রচনা করল। সেলিম আল দীন বলতেন, ‘আধুনিকতার অর্থ আমার কাছে সর্বগ্রাহিতা ও সৃষ্টিশীল নির্বাচন।’ বোধের বিচরণ, মানবিক প্রকাশ ও উঁচুতর কল্পনা। ইউরোপীয় আঙ্গিকের অন্ধ অনুকরণ নয়। সে প্রেক্ষিতে সেলিম আল ঐতিহ্যের পথ বেয়ে পাঁচালি, কথকতা, মঙ্গলপালাকে ধরে আধুনিকতার পথে হেঁটেছেন।

সেলিম আল দীনের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে একদিকে গবেষণা, শিক্ষকতা ও নাট্য, সাহিত্য রচনা নিয়ে সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকতেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজীর সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা- মফিজ উদ্দিন আহমেদ। মাতা- ফিরোজা খাতুন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। সেলিম আল দীন তার শিল্পীনাম; সার্টিফিকেটের নাম মু. মঈনুদ্দিন। স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেছা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও নানা জটিলতায় করটিয়া সা’দত কলেজ থেকে স্নাতক ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কপিরাইটার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে বাংলা বিভাগে যোগদান, পরে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হিসেবে আমৃত্যু (মৃত্যু: ১৪ জানুয়ারি, ২০০৮) কর্মরত ছিলেন। নাটক রচনা শুরু করেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। টেলিভিশন নাটক, মঞ্চনাটক, চিত্রনাট্যকার, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ ও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার নাটকগুলো বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত।

সেলিম আল দীন সাহিত্য চেতনার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি উপনিবেশ বিযুক্তিকরণের পথে হেঁটেছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ এ জাতিকে করেছিল শিকড়চ্যুত। উপনিবেশের ইতিহাস দেখিয়েছিল বাংলা নাটক শুরু হয়েছে ইউরোপীয় প্রেষণায়- লেবেদেফের মধ্য দিয়ে। তিনি এ ভ্রান্ত ইতিহাসের বিপরীতে ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন বাংলা নাটক হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ছিল। উপনিবেশের আকস্মিক সৃষ্ট নয়। তা ছিল নানা নামে, নানা রূপ-রীতিতে এ ভূখণ্ডের মানুষের শিল্পতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছে। প্রাচীন ভরতমুণির নাট্যশাস্ত্রেও এ বাংলা ভূখণ্ডে নাট্যচর্চার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। চর্যাপদের মধ্যে ‘নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী বুদ্ধ নাটকও বিষমা হই।’ প্রভৃতি গীতির মধ্য দিয়ে এ বাংলা নাটকের তথ্যই সুস্পষ্ট করে।

তিনি একে একে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের পরম্পরার ধারায় এ সময় বসে নির্মাণ করলেন হাজার বছরের জীবন সংস্কৃতির সৌধ। যে সৌধ যেন ছুঁয়ে দাঁড়াল বিশ্ব-আকাশ। ‘শকুন্তলা’, ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘ধাবমান’, ‘বনপাংশুল’, ‘নিমজ্জন’ প্রভৃতি নাটক উপনিবেশের মিথ্যা বড়াইকে অগ্রাহ্য করে হাজার বছরের বহমানতায় বিধৃত করল বাংলার নিজস্ব রীতি। প্রাচীন কথাসরিৎসাগরের মতো কখনো লম্বক, তরঙ্গ; কখনো পাঁচালির মতো পদ, বোলাম, নাচাড়ি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী রচনা আঙ্গিকের ধারাকে অনুসরণ করলেন।

সেলিম আল দীন দেখলেন আমরা আমাদের শিল্পকে মূল্যায়ন করি ইউরোপীয় চোখ বা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। তাই গভীর পর্যবেক্ষণে তুলে ধরলেন বাংলার নিজস্ব নন্দনতত্ত্বের মাপকাঠিগুলো। হাজার বছরের সাহিত্য-শিল্পরীতি বিশ্লেষণ করে দেখালেন বাঙালির সাহিত্য-শিল্প নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। শ্রীচৈতন্য দেবের ‘অচিন্ত্যদ্বৈতবাদ’ চেতনার নিরিখে এ তাত্ত্বিক ভিত্তি তুলে ধরেন। বাংলা পরিবেশনা শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য হলো একের মধ্যে বহুত্বের অবস্থান। একই আঙ্গিকের শিল্পের মধ্যে বহুবিধ আঙ্গিকের শিল্পের সমন্বয়। একের মধ্যে বহুর অবস্থান। উপনিবেশকালে আমাদের সাহিত্যে পাশ্চাত্যের ধাঁচে সৃষ্টি হয়েছিল শিল্পের আলাদা আলাদা বিভাজন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস এসব বিভাজনকে এটা তিনি অগ্রাহ্য করলেন। তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব শিল্পমাধ্যমের অপূর্ব সমন্বয়কে তুলে ধরলেন। শূন্যপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ইউসুফ জোলেখা, পদ্মাবতী, মহুয়া নানা সাহিত্যশিল্প কর্ম এক অদ্বৈত সমন্বিত শৃঙ্খলায় একীভূত। সেলিম আল দীন তার রচনায় দেখালেন বিদ্যাসাগর যে কলোনিয়াল শৃঙ্খলগুলো বাংলা গদ্যে করে গেছেন সেগুলো বাঙালিমাত্রই উচিত এই মুহূর্তে বর্জন করা। বাংলা ভাষার রীতি এবং প্রকৃতিতে এগুলো প্রয়োজন নেই। বাংলায় যতি, অর্ধযতি, পূর্ণযতিই যথেষ্ট, যা হাজার বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।

উপনিবেশের নাট্যরচনা কৌশলের অঙ্ক বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি উপনিবেশের চিহ্নগুলো বয়ে বেড়ানো অনর্থক বলে মনে করলেন। সে প্রেক্ষিতে নিজের রচনাগুলোর আঙ্গিক ভাবনায় বাঙলার মধ্যযুগের বিদ্যমান গদ্য-পদ্য অঙ্গ বিভাজনহীন সাহিত্য-শিল্পাঙ্গিকের উদ্ভাসন ঘটালেন। নিজের রচনাগুলোকে বললেন- নব্যপাঁচালি, কথানাট্য, বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির ইত্যাদি। বিশ্বপাঠে ফ্রান্স ফ্যানন, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা, হোমি কে বাবা, গায়ত্রি স্পিভাকের মতো সেলিম আল দীনের সাহিত্যে জাতীয় সংস্কৃতির আদর্শই বড় হয়ে দাঁড়াল। উত্তর-উপনিবেশ তাত্ত্বিকের মতো বিতর্কে অনুপ্রবেশ না করে সেলিম আল দীন নিরবচ্ছিন্নভাবে উপনিবেশের দুটো বছরের মধ্যখণ্ডন না থাকলে বাংলা সাহিত্য শিল্পের রূপরেখা কেমন হতো তারই নিরীক্ষার পথে এগোলেন। ইউরোপের মালার্মের প্রতীকবাদিতা বা ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিকবাদিতা কিংবা মার্কসীয় ঐতিহ্যহীনতা তত্ত্বের ভিন্নপথে জাতীয় ভূজীবনের দিকে তাকালেন।

সেলিম আল দীনকে শুধু নাট্যকার পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয়। তিনি মূলত একটি বৃহত্তর প্রপঞ্চ। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় সৃষ্টির অনিবার্য এক শিক্ষা। কীভাবে উপনিবেশের মিথ্যাচারের ফাঁদ থেকে বের হয়ে হাজার বছরের গৌরবান্বিত সংস্কৃতির আলোয় নিজেকে পুনর্নির্মাণ করা যায় তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। সেলিম আল দীনের একেকটি রচনা পাঠ মানে কাহিনির আস্বাদন নয়। ইতিহাস-সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা জাগরণের নতুন এক দীক্ষা। সেলিম আল দীন বলতেন, ‘ত্রিশের কবিরা যখন পাশ্চাত্যের ক্ষয়িষ্ণু জীবনচেতনা ও শিল্পরীতি আঁকড়ে ধরে বাংলা কবিতার মূলে নতুন কালের প্রসাধন মাখছেন, ঠিক সে সময় স্পেনের মাদ্রিদে একই পারে বসে লোরকা, নেরুদা, মেগুয়েল, হার্নান্ডেজ আঞ্চলিক গন্ধমাখা সাহিত্য রচনায় ব্রতী।’ সেলিম আল দীন চাইতেন, বাঙালি জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াক। ধার করা ইটে জাতির আত্মবিশ্বাসের দালান তৈরি বন্ধ হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকে আত্মস্থ করে নিজস্বতার পথেই বৈশ্বিক। তেমনি উপনিবেশের উন্মাতাল সময়েও মধুসূদন দত্তকে নিজস্ব পথে হাঁটতে দেখা যায়। সেলিম আল দীন চাইতেন শিল্প-সাহিত্য নিজস্ব ভূমি ও ভূগোলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোক।

অনেকেই আন্তর্জাতিকতা নিয়ে সেলিম আল দীনকে কটাক্ষ করতেন। অতীতকে ধরে আছে বলে পশ্চাৎপদ ভাবতেন। তাদের জবাবে তিনি বলতেন, ‘কোনো শিল্পেরই আন্তর্জাতিক ফর্ম হয় না। কারণ শিল্প দেশ-কাল, ধর্ম-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট ভূগোলের ওপর দাঁড়ানো। লাতিন আমেরিকান শিল্পরীতি আমাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে, তবে কাজ দেশ-কাজ ভূগোলের আশ্রয়ে সমূলিত।’

তিনি বিশ্বাস করতেন অন্যের অনুকরণ করে নয়, ঐতিহ্যের ধারায় বিশ্বনন্দনে হাঁটাতেই আত্মমর্যাদা। সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্মগুলো মূলত একটা শিক্ষা। যার পঠন-পাঠন, ধ্যান-অনুধাবনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি কীভাবে সাহিত্য-শিল্পে আত্মপরিচয় অর্জন করতে পারে তার শিক্ষা দেবে। সেলিম আল দীনের সাহিত্য-চেতনা এক কথায় হাজার বছরের বহমান সাহিত্যভাবনার জাগরিত চেতনা। দৈনিক বাংলা-র সৌজন্যে

শেয়ার করুন