নিউইয়র্ক     বুধবার, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাঙ্ক্ষিত নির্বাসন

বেনজির শিকদার এর কবিতা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০২:১৬ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:২১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বেনজির শিকদার এর কবিতা

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।
ভাতের লাগি নয়, একখান কাপড়ের লাগিও নয়
ব্যথিত বৈশাখ, খোঁয়ারি-স্বপ্নগ্রস্ত এইসব ভ্রূণহীন দিন
বিবর্ণ অনুভবে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া জীবনদৃশ্যাবলী
আমার ভালোলাগে না-আমি নির্বাসন চাই।

বিবেকের করিডোরে দীর্ঘশ্বাস পুড়ে যায় ব্যক্তিগত বোধ;
হিমঘরে শায়িত দুহিতা’র দেহ; ভীতু সেনাপতির মতো
দূরে বহুদূর, পালিয়ে যায় খোয়াবি ভোর! নাকছাবি প্রেম
প্রিয়তম আকাশ, বেহুলা বাতাসে— কাঁপে থরথর।

যেন চম্পকনগর ছাড়িয়ে গোটা জাহানময়—
ব্যাকরণহীন-ঔদ্ধত্য-উন্মাতালে সর্পকূলের মাতম!
শূন্য করতল, নীলক্ষতে কুঁকড়ে যায় অনিকেত প্রেম,
লোলুপ দৃষ্টিতে উপচানো ক্ষুধার্ত বাঘের দখলি-প্রান্তর
ঘ্রাণহীন-প্রাণহীন স্রোতের বিপরীতে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ স্বর।

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।
ভাতারের লাগি নয়; একখান ভিটার লাগিও নয়
অনন্ত ফেরারির মতো ক্ষমতা প্রহরীর সেয়ানা চোখ;
মাকড়সার জাল, নীল-নকশায় সাজানো দাবার ছক
আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

প্রণত মস্তিষ্ক নয় অহিনকুল মত্ততায় বোধিবৃক্ষ মানুষ
কুহেলিকা রাত্রি— ব্যাঘ্র হুংকারে জাগে মন্বন্তর কুকুর!
বাতাসে লক্ষীপেঁচার ভুল সংকেত; গৈরিক বসনে—
কাঁদে জাহ্নবী-জল! ভালোবাসা পরে আছে লৌহশেকল!

অনিদ্রার আগুনে দগ্ধীভূত; ত্রাতাহীন অসহায় ত্রাণ
মায়ার নিবিড়ে অনুর্বরতা-প্রাণের নিবিড়ে মানবিক হ্রাস
ঊর্মিল উন্মাদনায় অনুভূতির জলাশয়ে শ্বাসরোধের চাষ;
কালকেউটের ছোবলে লীন পৃথিবীর মুখ-গ্রীবা-কণ্ঠস্বর
নালিশ নেই; ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান—সমীপেষু বরাবর।

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।
সোহাগের লাগি নয়; একখান সংসারের লাগিও নয়
জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি— ভালোবাসার শেষ সমর্পন
নতজানু প্রেম, পৌষালি চুমু— এই সব অকাল-সংযোগ;
আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

লালিত সম্ভ্রম

তোমাকে দেখতে দেখতে—
পাহাড় বেয়ে সমুদ্র হলো—
গত শতাব্দীতে জন্মনেওয়া তিন তিনটি ঝর্ণা।
নহলী সূর্যটা হেঁটে যেতে চাইলো আলপথ ধরে;
আদি হতে অন্তহীন!
নগরবাসীরা গলা ছেড়ে ধরলো প্রেমের বাঁশি; মায়াবী বীণ!
অথচ তুমি ফিরেই তাকালে না!

তোমাকে ভাবতে ভাবতে—
সকাল গড়িয়ে দুপুর—
বয়ে গেলো নতজানু ষোড়শী সন্ধ্যা।
বড় বিবমিষায় চুরি হয়ে গেলো আদিবণিকের কথাকল্প।
পৃথিবীও জেনে গেলো মরে যেতে যেতে—
অনন্ত অপেক্ষা; নেকড়ে চাঁদের!
অথচ তুমি জানতেই চাইলে না!

তোমাকে চাইতে চাইতে—
মৃত-ঘাম শুকালো কপালের ভাঁজে—
পুঁইলতার নেতানো যৌবনে কেটে গেলো আলোকবর্ষ মাস!
একদিন দুদিন; পুরোনো মদের মতো গাঢ় হলো—
কঠিন ব্যামোর বাড়ন্ত শরীর!
প্রগতিশীল বুক কেঁপে উঠলো; বাড়লো কষ্টের নীড়!
অথচ তুমি বুঝতেই চাইলে না!

তোমাকে বুঝতে বুঝতে—
ক্ষয় হলো জীবনের গোটা ক্যানভাস—
অনভিযোগ স্তব্ধতায় ফসফরাসের সাগর ডিঙিয়ে;
ভুল পথে হেঁটে গেলো নামহীন অহেতু পথিক।
সরলের গরল পান করে মরে গেলো ছায়া;
হরিণের গলায় আঁটকে গেলো মৃতবাঘের হাড়;
হিসেবের ডালপালায় বীভৎস নাভিশ্বাসী অশরীরীর বাস!

ভ্রান্তি নয় সত্যের বৈজয়ন্তী—
শুধু একবার বললে ভালোবাসি—
হতে পারতো আগুনের গল্প! নীলাভ ভ্রমর!
কিংবা নদী! কিংবা পাহাড়!
হিজলের ফাঁদ হাঙ্গরের দাঁত চিরে—
ভেসে যাওয়া যেত কোজাগরী জোছনায়!
আমার ঈশ্বর সাক্ষী—
সম্ভ্রমে রাখি তোমায়, রাখি জিজীবিষা মায়ায়!

পরিতাপ

এখানে পিঠ পেতে দাঁড়িয়ে আছে একখানা তন্ময় দুপুর
মাছের গালিচায় বড়শি গেঁথে চলছে সুকৌশলী খেলা।

বৈদ্যুতিক তারে ঝুলে থাকা দাঁড়কাকের মতো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে এখানে দোদুল্যমান নষ্টামি ও ভেলকিবাজির লকলকে জিভ ।

মণি-মুক্তোর চাষ দেখে ঈর্ষায় তাকিয়ে খানিক,
এখানে অবান্তর যুক্তিতে ছেড়ে যায় আড়চোখি সুদীর্ঘ ট্রেন।

কোমল বিকেলে একখানা ঘর-বিবাগী কাক; ডাকে কা কা কা
মহল্লার কুকুরটি এসে অভুক্তই ঘুরে যায় এবাড়ি ওবাড়ি।

রানির মতো ফুটে থাকা ষোড়শী চেরিগুলোকে দেখে
জোয়ারে ভাসায় জল আটলান্টিকের অতলান্তিক বুক।

খুলে দিয়ে বুকের বোতামখানি, পর্যটক আকাশটা;
গার্হস্থ্য-প্রেমে এখানে মাঝেমধ্যে ঢেলে যায় অমৃতকুম্ভজল।

কেবল এখানে কোনো ঈশ্বর নেই;
নেই কোনো অদৃশ্য কারিশমা;
যা থামিয়ে দিতে পারে আয়না বিক্রির মোকাম,
কূপমণ্ডূকতার শোরগোল কিংবা ভেসে আসা
ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত চিৎকারে অব্যাহত মৃত্যুর হিড়িক।

বিবসন ঔৎসুক্য

একদা এইখানে সমুদ্দুর ছিল!
বিকেলটা প্রায়ই সেজেগুজে এসে কাছ ঘেঁষে বসতো!

সূর্য পাঠাতো চুমু
পৃথিবী পান করে অস্তরাগের ঠোঁট! সঙ্গমসুখের উজ্জ্বলতায় এক আচাভুয়া বাতাসের গাল বেয়ে নামতো
শামুক কুড়ানো ক্ষণ!

ছিল বারোমাসে তেরো পার্বণীয় আয়োজন!
কবোষ্ণ প্রেমের অনুগ্রগন্ধে শ্যামলিমা চাষির মতো
শতবর্ষীয় আর্তির থালায় ঘাটে ঘাটে জমতো মেলা।

সোনার কলসের মতো আনচান প্রাণ;
পারিজাত সুবাসে ছুঁয়ে দিতো দূরগামী কাপালিক চাঁদ!

আজ ফণীমনসার মতো এ বাড়ন্ত বেলায়
খালাসির তাড়া নেই, নেই পায়চারি সুকানির।
ভূতগ্রস্ততায় মাঝেমাঝে চুপচাপ উড়ে যায়
প্রিয়হারা কিছু ম্লানমুখী মধ্যবয়সী মেঘ।
চারিদিকে ক্রোধানল, দাউদাউ ক্ষিপ্রতার লাস্যময়ী ভিড়।

পুরোনো দেয়ালের মতো লেগে থাকা সেইসব দাগ
নিসর্গ নয়; খরস্রোতা নদী হয়ে ঢেউভাঙে
বিহঙ্গ চোখে বিবসন ঔৎসুক্য; চেয়ে চেয়ে অন্ধকার।

এখন সুমুদ্দুর নয়; এখানে কেবলই হৃদয়পোড়ার গন্ধ।

শেয়ার করুন