নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সন্দীপ দত্ত

বিষ্ণু দে’র কাব‍্যভাবনা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:১৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩ | ০২:২৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিষ্ণু দে’র কাব‍্যভাবনা

কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে। যখন ক্ষয়ে যাচ্ছে মন,জমছে বিতৃষ্ণা,হারিয়ে যাচ্ছে বিবেক,তলিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাসবোধ। একটা যুগ যখন আসে,সে এক বার্তা নিয়ে আসে। সেই যুগেরই বার্তা বহন করে সাহিত‍্য। কাব‍্যজগতে তাই সৃষ্টি হল নতুন গোষ্ঠী। যে গোষ্ঠী হৃদয়ের আঘাত সহ‍্য করে করে অনুভব করল সেই আঘাতের যন্ত্রণা। বোধহয় যন্ত্রণাই মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলে। প্রতিবাদ করবার ভাষা জোগায়। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সম্মানের জন‍্য পথান্তরের পথ চায়। রবীন্দ্রনাথ যাকে নদীর বাঁধ বলেছেন। “………সেই বাঁধটাকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়,মর্জি নিয়ে।” সেক্ষেত্রে জীবনানন্দের কবিতাতেও আধুনিকতা এসেছে। সুধীন্দ্রনাথ,অমিয় সকলের কবিতাতেই ফুটে উঠেছে সেই নতুন দিগন্তের ছবি। কিন্তু এখানের আলোচ‍্য বিষয় যেহেতু কবি বিষ্ণু দে,তাই মানুষটার কাব‍্য মানসিকতা ও কলম নিয়েই বলা যাক।

অনেকেই বলে থাকেন বিষ্ণু দে’র কবিতা বড্ড বেশি র্দুবোধ‍্য। র্দুবোধ‍্যতা আসলে কী,এটা আগে জানতে হবে। আমরা যে বোধটাকে সহজে জাগাতে পারিনা,বলা ভাল জানতে পারিনা তার জটিলতার ব‍্যাপ্তি,তখনই হোঁচট খাওয়ার একটা প্রশ্ন ওঠে। এই হোঁচটটাই চেনা ছন্দকে ভেঙে দেয়। পাঠকদের মনে রাখতে হবে আধুনিক কবিতার রাস্তাটা ভাঙাগড়ার মধ‍্যে দিয়েই এগিয়েছে। সময় যেখানে র্দুবোধ‍্য,মননে যখন গিঁট লেগে যাওয়ার ক্ষণ চলছে,কবির ভাষা,কবিতার ভাষা তখন তো র্দুবোধ‍্য হবেই। এই র্দুবোধ‍্যতা নিয়ে ইংরেজ কবি ও সমালোচক stephen spender এক জায়গায় ব‍্যাখ‍্যা দিয়ে বলেছেন,”The result of that excessive outwardness of ‘a spiritually barren external worlds is the excessive inwardness’ of poets who prefer losing themselves within themselves to losing themselves outside themselves in external reality.”

একজন কবির অন্তর্দৃষ্টি যত সম্পূর্ণতার দিকে এগোয়,তত তাঁর ভাষাশৈলী,শব্দের কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। পাঠকের কাছে এই নতুন মোড়কটাকেই বলা যেতে পারে দুরূহতার মূল কারণ।আত্মবিরোধও কখনও কখনও প্রচ্ছন্ন বোধের সৃষ্টি করে। বিষ্ণু দে’র কবিতার মননধর্মিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক অন্তজ্ঞানের সম্মুখীন হতে হয়েছে পাঠককে। এই অন্তরজ্ঞান তাঁর কবিতা না বোঝার পেছনে একটা বড় দিক ছিল।গঠনশৈলীর ক্ষেত্রে বৈদগ্ধ‍্যের এই ছ’টাই বিষ্ণু দে’কে বিষ্ণু দে’র জায়গায় রেখেছে। সম্মান দিয়েছে পর্যাপ্ত।

এলিয়টের সঙ্গে বিষ্ণু দে’কে অনেকেই তুলনা করে থাকেন। এলিয়ট এবং বিষ্ণু উভয় কবির কাছেই এ যুগ হয়ে উঠেছে অসহ‍্য;গুমোট। তবে এলিয়ট মেঘের গর্জনই কেবল শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণু দে অপেক্ষা করেছেন কাতর চাতকের মতো। একফোঁটা জল কবির কাছে যেন বহুদিনের প্রত‍্যাশা। হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসটা ফিরে আসুক–এটাই চাইছিলেন কবি। রবীন্দ্রনাথের মতো বিষ্ণু দেও সৌন্দর্যের পূজারী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই চিন্তা থেকে বিরত হতে বাধ‍্য হলেন আধুনিক যুগযন্ত্রণা দেখে। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’কাব‍্যগ্রন্থের ‘ছেদ’কবিতায় কোনও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন,”হেথা নাই সুশোভন রূপদক্ষ রবীন্দ্র ঠাকুর।”

‘চোরাবালি’কাব‍্যগ্রন্থের ‘টপ্পা ঠুংরী’কবিতায়,কিংবা ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘যমও নেয় না’ প্রভৃতি কবিতায় লোকউপাদানের বিশেষ শৈলীকে তিনি ব‍্যবহার করেছেন যথাযথ। আবার ‘ক্রেসিডা’য় লোক উপাদান গ্রীক পুরাণ কথা হিসেবে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও বিষ্ণু দে’র মনে হয়েছিল,”……তবু তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) ব‍্যক্তিস্বরূপ নদীর মুখর স্রোত নয়,সংহত সত্তা হিমালয় নামে নগাধিরাজ যেন।…….তবু মোটামুটি বলতে হবে যে তাঁর নক্ষত্রবিহারী প্রতিভা বাংলার রসালো মাটিতে আমাদের প্রাত‍্যহিক বাস্তবতায় বিরাজমান থেকেও বহু ঊর্ধে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেখানে মধুসূদন বা দীনবন্ধু বরং আমাদের চেনা অগ্রজ।” এ বিরূদ্ধ আচরণ ব‍্যক্তি রবীন্দনাথকে নয়,রোম‍্যান্টিকতার আতিশয‍্যের বিরূদ্ধে খড়্গ তোলা। কবি বিষ্ণু দে’র কলম থেকে যখন যা কবিতা নেমে এসেছে,কিংবা কবিতাকেন্দ্রিক ভাবনা ও বক্তব‍্য—প্রতিবারই অবাক হতে হয়েছে পাঠকদের। হতে হয়েছে গর্বিত। পুণ‍্যে পুণ‍্যে ভরে উঠেছে বাংলার জল মাটি।

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন