নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এইচ বি রিতা

ছুঁড়ে ফেলিনি বিরতি চেয়েছি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩ | ১২:১০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩ | ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ছুঁড়ে ফেলিনি বিরতি চেয়েছি

(১)

সূর্য ডুবে গেছে সেই কখন। সন্ধ্যার আকাশে এখন রঙেরা হাঁটছে নূপুর পায়ে। কমলা-গোলাপী রঙগুলি বাতাসের মৃদু হাওয়ার সাথে যেন ফিসফিস করছে। আকাশটিকে দেখাচ্ছে বিস্তৃত ক্যানভাসের মতো। সেখানে বিনা দাওয়াতে মেঘেদের দল বিবর্ণ আলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে নাচতে শুরু করেছে। প্রতিটি মেঘের গালে দিনের আলোর শেষ অবশিষ্টাংশ দ্বারা সূক্ষ্ম ব্লাশের ছাপ পড়েছে। সারাদিনের দুশ্চিন্তা থেকে ভার মুক্ত হয়ে সন্ধ্যাটি যেন প্রশান্তির একটা আভাসে নিজেকে ঘিরে ফেলেছে। পাখির কিচিরমিচির ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। সিকাডাসের সুর পাতার কোলাহল থামিয়ে দিয়ে সন্ধ্যার জন্য তৈরি করছে নির্মল একটি সাউন্ডট্র্যাক।

সোনালি আভা কমে যাওয়ার সন্ধ্যার বুক মাড়িয়ে তারাগুলো এখন একত্রিত হচ্ছে আকাশের বুকে। কৌতুহল নিয়ে তারারা চোখ মেলছে, পৃথিবীতে তাদের মৃদু আলো ঢালাই করে যেন স্বপ্ন এবং আবেগকে জ্বালানোর ষড়যন্ত্র করছে। প্রকৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত ফুলেদের ঘ্রাণ বহন করছে বাতাস স্নেহভরে, ফায়ারফ্লাইসের মতো ঝিকিমিকি আলো রাতের আকাশে শহরের দৃশ্য বদলে দিচ্ছে। ওদিকে রাস্তাগুলোতে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলতে শুরু করেছে। শহরটি ধীরে ধীরে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।

সুন্দর সন্ধ্যাটি হারিয়ে ফেলতেই রিয়ার মন-বিষাদে ভরে উঠল। বিষণ্ণতায় ভরা মনে তার আবেগগুলি প্রবল এক উথাল পাথাল সমুদ্রে পরিণত হচ্ছে। আর হৃদয়ে তখন একটি অবর্ণনীয় ভার অনুভব করতে শুরু করল রিয়া। এমন মুহূর্তে রিয়ার প্রতিটি নিঃশ্বাস হতাশার জোয়ারে লড়াই করে। এই সময়, অশ্রু-ই কেবল তার তিক্ত এবং মিষ্টি মুক্তির উপায় হিসাবে কাজ করে। রিয়া তার মনে অব্যক্ত কথা আর ব্যথার বোঝা বহন করে চলছে বেশ ক’দিন। কখনো এই মনই তাকে গোলকধাঁধায় ফেলছে। স্মৃতিগুলো ঘুরি ফিরে আসতেই ‘কী হবে’-একটা ভুতুড়ে আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি তার ভিতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন নিজের একটা অংশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়জনকে হারানোর অপূর্ণ স্বপ্নের হতাশার মধ্যে প্রবেশ করে আছে রিয়া।

কেলম্যান সেদিন বলল, ঠিকঠাক ঔষদ নিচ্ছো তো?

রিয়ার অব্যক্ত যন্ত্রনার কথা কেবল সে-ই জানে।

-হ্যাঁ। নিচ্ছি।

-গুড। নিয়মিত নিতে হবে। ডোজ মিস করা যাবে না।

-কতদিন নিতে হবে?

-যতদিন তুমি নিজেকে সামনে নিতে না পারছো।

-চেষ্টা করছি ভুলে যেতে।

-শোন! মানুষ কোনো ব্যথা বা যন্ত্রণার মুহূর্তই ভুলতে পারে না। ভোলার চেষ্টা করাও ঠিক না। বরং মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে হবে।

রিয়া চেয়ারটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

-নেক্সট ভিজিট কবে?

-যখন তুমি দেখা করতে চাও।

-ওকে, ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে এপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি।

কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটি নিয়ে বের এসেছিল রিয়া সেদিন ইথুপিয়ার মেন্টাল হেল্থ ক্লিনিক থেকে। এখানে প্রতি সপ্তাহে একবার রিয়া আসে থেরাপি নিতে। থেরাপি বলতে কাউন্সেলিং হয় তার হেলম্যানের সাথে। তার সাথে কথা বলে কিছুটা স্বস্তি পায় রিয়া। নিজের আবেগকে সামলে নিতে শিখছে এখন। প্রথম দিনই হেলম্যান বলেছিল, হতাশা জীবনের এক স্বাভাবিক অধ্যায়। কম বেশি সবাই এই যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়। ব্যাপার না। শুধু কারণটা খুঁজে বের করতে হবে, ব্যাস! তারপর তুমি নিজেই সেটার সমাধান করতে পারবে।

রিয়ার বেশ ভালো লেগেছিল তার কথাগুলো।

হ্যাঁ ! রিয়া জানে তার হতাশার কারণ। তাই সবকিছু সামলে নেয়া কিছুটা সহজ হচ্ছে এখন। তবু অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত দমকা হাওয়ার মতো ফিরে ফিরে আসে, যা তার আশার জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দেয়। এই ব্যথার আলিঙ্গনে জগতটি রঙহীন দেখায়, ব্যথার মাঝে একটি কোমল দুর্বলতা লক্ষ্য করে সে-যা কখনো কখনো তাকে ক্ষুদ্ধ করে। পরক্ষণেই ঝড়ের মেঘ ভেদ করে সূর্যের আলোর মৃদু রশ্মির মতো তার বিষাদগ্রস্থ মন স্বাভাবিক হয়। দুঃখের ছায়ায় সুখের জন্য নতুন উপলব্ধি খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। নিজেকে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কী আছে তার মাঝে? কেন এতো অবজ্ঞার পরও তাকে মনে রাখতে হয়? সম্পর্কটা শুরু না হতেই যে বলে দিল, কিছুদিন বিরতি চাই, সে আসলে কী চেয়েছিল তা বোঝা কী খুব কঠিন? প্রেম-কখনো অবসর চায় কী? নাকি আরশোলাদের মতো সুযোগ বুঝে বিরক্তি ‌অনিহা, সম্পর্কে ঢুকে পড়লেই মানুষ বিরতি চায়?

দুই মাস পর গতকাল সে জানতে চাইলো, কেমন আছো?

কী করে বলে সে কেমন আছে! কেমন আছে বলতে গেলেই তার ভিতরে অনুভূতির বিশাল বিস্তৃতি জমা হয়, উজ্জ্বল রঙের ফুলে পূর্ণ তৃণভূমি থেকে সে হয়ে উঠে একটি আগুন, উষ্ণতা এবং আলোতে জ্বলজ্বল করা মুখ তার অন্ধকারের সন্ধ্যায় বিলীন হয়। বাতাসের ফিসফিসানিতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠা তার মন অসংখ্য টুকরোর একটি পাজলে পরিণত হয়, যেখানে প্রত্যেকটি টুকরো তাকে বিরহের গান শোনায়। কী করে বলে সে কেমন আছে! এ অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, লড়াই কেবল নিজের সাথেই চলে রিয়ার।

(২)

ব্রাশের প্রতিটি স্ট্রোক তার শিল্পের অব্যক্ত ভাষার, একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠছে দিন দিন। ভেতরে যা আছে জমা সবটুকু‌ই যেন আজ তার ব্রাশস্ট্রোকে দৃশ্যমান এবং ভাবপূর্ণ। রিয়া হাত নাড়তে নাড়তে উপলদ্ধি করে ব্রাশের স্ট্রোক, গতিবিধি।ব্রাশটি যেন ক্যানভাসে অঙ্কনের জন্য কেবল একটি সরঞ্জামই নয়, এটি প্রতিটি স্ট্রোকের সাথে তার ভাবনা ও আবেগের আকার, দিক এবং তীব্রতাকে কখনো সহজ করে তোলে, কখনো বা জটিল বিবরণে একটি টেক্সচার তৈরি করে।

ব্রাশস্ট্রোক পেইন্টিং-এর প্রতি রিয়ার আগ্রহ জাগে হেলম্যানের অফিসে ভিনসেন্ট ভ্যান গো’র ‘দ্য স্ট্রারি নাইট’ তেল রঙের ছবিটি দেখে। দেয়ালে ঝুলন্ত ছবিটি গো’র অভিব্যক্তিপূর্ণ ব্রাশট্রোক, যা রাতের আকাশকে আলোর বিস্ফোরণে পূর্ণ করেছে। তারাগুলি উজ্জ্বল এবং মিটমিট করছে, দীপ্তিময় অর্ধচন্দ্রে- তৈল রঙের স্ট্রোকগুলি কী নিপুনতায় বৈপরীত্যের সাথে পেইন্টিংটিকে জীবন্ত করে তোলেছে। ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে রিয়া দেখছিল চিত্রটি সেদিন। সে চাহনি দেখে হেলম্যান বলেছিল,

-তুমি কী অ‌ঙ্কন পছন্দ করো?

-হ্যাঁ।

-পেনসিলে নাকি রঙ তুলিতে?

-রঙ তুলির ব্রাশস্ট্রোক।

-তাহলে অবসর সময়টুকুতে তুমি সেদিকে মনোনিবেশ করতে পারো। মনকে বর্তমান চিন্তা থেকে বিমুখ করো। এমন কিছু করো যা তোমাকে আনন্দ দিবে। এতে করে তোমার মন ভিন্ন আমেজে তোমার মনের শক্তিকে আরও ইতিবাচক এবং উৎপাদনশীল ক্রিয়াকলাপের দিকে পুনঃনির্দেশিত করবে। রিয়ার মনে ধরেছিল হেম্যানের কথা। তারপর থেকেই অনেক শিল্পীদের বিভিন্ন ব্রাশস্ট্রোকের তৈলচিত্রগুলো সে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকে। বিশেষ করে, ইমপ্রেশনিজমে, ক্লুদ মুনে এবং এডগা দুগাহ’র মতো শিল্পীরা কীভাবে আলো এবং বায়ুমণ্ডলের ক্ষণস্থায়ী ছাপগুলি ক্যাপচার করতে পৃথক দৃশ্যমান ব্রাশস্ট্রোক ব্যবহার করেছিলেন, তা রিয়াকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। মুনে’র ‘ওম্যান ইন দ্য গ্রিন ড্রেস’-এ মোটা ব্রাশ স্ট্রোকের কাজটি ভীষণ মুগ্ধ করেছে তাকে। তারপর বোঝার চেষ্টা করেছে জ্যাকসন পোলক এবং উইলেম ডি কুনিং-এর বিমূর্ত যোগাযোগের অভিব্যক্তিপূর্ণ ব্রাশস্ট্রোকগুলো। তবে তাদের কাজগুলো বেশ কঠিন মনে হয়েছে তার কাছে।

তারপরই রিয়া কিনে নিল বেশ কিছু ব্রাশ, বিভিন্ন ধরনের রঙ, পেলেট, কিছু কাগজ, ক্যানভাস। শুরু হলো তার নিজেকে ভিন্ন এক রূপে প্রদর্শন করার চেষ্টা। দিনের পর দিন ব্রাশগুলোকে রঙ মাখিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো নিজের ভেতরের ভাবনার গভীরতা তোলে ধরতে। কিছুটা হলেও আজ সে নিজের বিমূর্ত ধারণা ও টুকরো টুকরো ব্যথাগুলো ব্রাশওয়ার্কের স্তর এবং বৈচিত্র্যে সাজাতে পারে। কিছুটা হলেও নিজেকে অতীতের স্বল্প পরিসরের সেই যন্ত্রণাময় ভাবনাগুলো থেকে মুক্তি দিতে শিখেছে রিয়া।

হেলম্যান বলেছিল, ভাঙা সম্পর্ক থেকে নিরাময় হল একটি নতুন যাত্রা, যার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, আত্ম-প্রেম এবং ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা। রিয়া তাই করেছে। ছেড়ে দিয়েছে তাকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই। বলেছিল সে, ছুড়ে ফেলিনি, বিরতি চেয়েছি। তাই আশা ধরে রেখেছিল মনে, হয়তো ফিরবে। প্রেমের বিরতি এত দীর্ঘ হবে-কে জানতো ! আজ আর সেই বিরতি রিয়াকে কাবু করে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে তার বুকের ব্যথা বাড়ায় না। আজ সে বুঝে গেছে, এই বিরতি ছিল ছেড়ে যাওয়ার এক অজুহাত। অতীতের ক্ষতগুলি ভবিষ্যতে মানুষকে আরও গভীর এবং খাঁটি করে তোলে, যা রিয়াকেও করেছে।

ক্রিং ক্রিং ক্রিং ! তার ফোন কল বেজে চলেছে। তবে কী আজ বিরতির সমাপ্তি হলো ? রিয়া ফোনটা বন্ধ করে দিলো। তার আজ বিরতি দরকার।

এসএ/এমএএস/এমইউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন