নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিলেকোঠার আলো

সোহানা নাজনীন

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০২:৩০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:৪১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
চিলেকোঠার আলো

দিনের আলো নিভে যাবার পর আমার বেডরুমে সাধারণত খুব একটা ঢুকিনা। বসার ঘর আর রান্না ঘরে হাতের কাজ সারতেই রাত দশটার বেশী বেজে যায়। তার আগ পর্যন্ত আমার ঘরে লো-পাওয়ারের বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলতে থাকে। জানালা ঘেষে আঙ্গুর গাছের ঘন ঝুপড়ি কালো হয়ে আছে, বাতাসের মিষ্টি গন্ধে বোঝা যায় আঙ্গুর গুলোয় হলুদ রং লাগতে শুরু করেছে। সাদা “হানি সাকল” ফুটে আছে বেড়ার গা আলো করে, অনেকটা আমাদের দেশের কামিনীর মতো মাতাল গন্ধ। নীল জমিনের উপর সাদা লেসের পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে আরো দূরে তাকাই, দেখি পিছনের বাড়ীটার চিলেকোঠার ঘরে বাতি জ্বলছে। বাতিটা প্রতি রাতে জ্বলে, অনেক রাত অবধিই জ্বলে। মাঝরাতে কখনো ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় শুয়ে থেকেই জানালা গলে তাকাই। দেখি দুরে ওই বাড়ীটার চিলেকোঠায় আলো জ্বলে আছে। কে জেগে থাকে এতো রাত অবধি! খুব একটা লোক সমাগম দেখিনি, বাড়ীটাও বড্ড অদ্ভুত! এই পাড়ার সবচাইতে পুরনো, জীর্ণ, বিবর্ণ বাড়ী। সামনে কোন বেড়া নেই, বাহারী ফুলের গাছ নেই, চিঠির বাক্সটাও ভেঙ্গে হেলে পড়া একদিকে। বহুদিন যাবত রঙ পড়েনি দেয়ালে, সবুজ জানালা থেকে পেইন্টিংয়ের ছাল জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ছাদের বাকানো কার্নিশে আগাছা জন্মে ঝুলে পড়েছে, তাতে কাঠবেড়ালী খেলা করে। বাড়ীর সামনের অহেতুক বাড়ন্ত ডালগুলো পথচারীকে খোঁচা দেবার জন্যে খিঁচিয়ে আছে। বাড়ীটার পিছনে দুহাত সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে মান্ধাতা আমলের জঙ্গে ধরা গাড়ী পড়ে আছে বহুকাল ধরে। সমস্ত কাঠামোটায় কেমন যেন একটা ভেঙ্গে পড়া ভেঙ্গে পড়া ভাব। ব্যাক ইয়ার্ডে কোন সামারেই বারবিকিউ করেনি কেও, কাপড় শুখাতে দেখিনি, এমনকি কোন বাচ্চাও খেলতে দেখা যায়নি। অথচ বাড়ীর পিছনের উঠোনটা বেশ বড়, আমার জনালা দিয়ে দিব্যি দেখা যায়। শুধু শুকনো পাতার রাশ, সাথে গাদা দিয়ে রাখা কিছু ফেলনা মালপত্তর পুরনো কার্পেটে দিয়ে ঢাকা।

প্রায় সকালে বাচ্চা স্কুলে দেবার পথে বাড়ীটায় অভ্যাসবশত চোখ পড়ে। কখনো দেখি পুরুষালী গড়নের এক বিশালদেহী সাদা মহিলা বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসছে। সাথে দুই বেনী করা ফড়িঙ্গের মতো ছোট্ট একটা মেয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে মহিলার পিছনে। প্রসাধনহীন সাদা ফ্যাকাসে মুখটায় একরাশ নিরুদ্বেগ মেখে কোনরকম কমনীয়তা ছাড়াই হেলেদুলে পাশ কেটে যেত। যাবার সময় কোনদিন চোখে চোখ রেখে, একটু হেসে বলেনি, “good morning”. পাথরের মতো কোদানো মুখে থাকতো বিরক্তিকর এক অভিব্যাক্তি, যেন সাফল্যহীন জীবনের প্রতি তার ব্যাপক অভিযোগ।

কখনো রাতে খাবারের পর হাটতে বের হলে দেখতাম মহিলা তার বাড়ির সামনে বসে আইপ্যাডের উপরে ঝুকে আছে। অস্পষ্ট আলোতে মাথার উপরে তুলে দেয়া হুডির পাশ থেকে তীব্র খাড়া নাক উঁকি দেয়। অস্থির আঙ্গুলে সিগারেট চেপে রেখে বিড়বিড় করছে। অনেক রাতে তার স্বামী বাড়ী ফেরে, ছোটখাট একজন চকচকে চর্বিওয়ালা স্প্যানিশ। তারা দুজনে পাথর কঠিন মুখ নিয়ে সাবধানী দূরত্বে পাশাপাশি হেটে যায়, মহিলার কাঁধের অনেক নীচে তার স্বামীর কাঁধের উচ্চতা। দুজনের জুটি দেখে খুব একটা বাহবা দেয়া যায়না, ভালোবাসাবাসির নিঃশর্ত হাসি হাসেনি কোনদিন তারা। তারপরেও তারা ওই বাড়ির বাসিন্দা দুজনে, শব্দহীন বসবাস, চাকচিক্যহীন জীবনযাপন। ধোয়াটে রহস্য থাকা সত্ত্বেও ওই বাড়ির চিলেকোঠার আলোটা আমাকে বড্ড টানে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে আমি চিলেকোঠার দিকে চুম্বকের মতো তাকাই, খুব ভালোবাসি ওই আলো দেখতে, ঠিক যেন বাতিঘর। সুমুদ্রে দিক হারানো নাবিকের মতো আমিও যখন জীবনের হিসাব নিকাশের যন্ত্রণায় হাপিয়ে উঠি তখন চিলেকোঠার বাতিটাই আমাকে পথ দেখায়। অদ্ভুত জুটির মতো ঐ দম্পতির জ্বালানো আলো দেখি আর ভাবি,

“এইতো বেশ আছি, ভালোই আছি। আমার যা কিছু দুঃখ-কষ্ট-অপমান-অনুশোচনা, একান্তই আমার আপন। বুক পাঁজরের সিন্দুকে ভরা থাকুক সব, কাওকে দেখাবো না এই কষ্টের আলমারি। এরই ফাঁকে ফাঁকে কালো চাদরে বোনা বুটিদার জরির মতো আলো ছড়ানো কিছু সুখপ্রাপ্তি আর ভালোবাসা, এও কি কম?”

শেয়ার করুন