নিউইয়র্ক     বুধবার, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবেদীন কাদের

কবি বিষ্ণু দে’র ‘কনডিসনড রিফ্লেক্স’ কবিতা ও আমার বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা !

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:০৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩ | ০২:১৬ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
কবি বিষ্ণু দে’র ‘কনডিসনড রিফ্লেক্স’ কবিতা ও আমার বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা !

আমার শ্রদ্ধেয় লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান কয়েকদিন আগে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সাতের দশকের গোড়ায়, সম্ভবত ‘৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে শান্তি পুরস্কার দেয়ার পর এর কর্ণধার বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন ‘সম্ভবত সত্যিই আপনার দেশের সকল বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।’ এটি তিনি বলেছিলেন ঢাকায় কিছু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলার পর। মোরশেদ ভাই বলেছেন এটি একটি গল্প হয়তো। আমার মনে হয় গল্প নয়! অনেকদিন আগে আমার একটি স্ট্যাটাসে আমি মনোবিজ্ঞানের একটি বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। আমার সহকর্মী যারা মনোবিজ্ঞান পড়ান তাঁদের একজনের কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই নিয়ে কয়েক বছর আগে পড়ার সময় বিষয়টি জেনেছিলাম। একটি ব্যাঙকে গরম কড়াইয়ের মধ্যে ছেড়ে দিলে সে একটু নড়ে চড়ে আবার ঠিক ভাসতে থাকে। এভাবে কয়েক মিনিট পর পর ৫ ডিগ্রী করে তাপ বাড়ালে সে একটু নড়ে ওঠে, আবার ঠিক ভাসতে থাকে। এভাবে তাপ বাড়াতে বাড়াতে ৯৫ ডিগ্রীতে গেলে ব্যাঙটা প্রায়-নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তারপর ১০০ ডিগ্রীতে নিলে ব্যাঙটা আর নড়ে না, একেবারে নিস্তেজ হয়ে মরে যায়। অন্যটি পাব্লভ’স ল, যা প্রায় সবাই জানেন। কুকুর ঘণ্টা বাজলেই খেতে দৌড়ায়, কিছুক্ষণ আগে খেলেও। আর সবশেষে আমার মনে পড়ে ‘কনডিসনড রিফ্লেক্সে’র কথা।

এখন থেকে ৪১ বছর আগে ‘৭৮ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি পাড়ার আড্ডায় আমার ভীষণ প্রিয় কবি আবু করিম ভাই আমাদের বিষ্ণু দে’র ‘কনডিসনড রিফ্লেক্স’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাতেন, ‘অভ্যাস শুধু অভ্যাস লিলি তাই তো আসি/ অভ্যাস শুধু অভ্যাস লিলি ভাল তাই তো বাসি’। এরপর বাকী সব চরণগুলোও আওড়াতেন। এটি আমার প্রিয় কবিতার একটি। আর ছেলেবেলায় পড়া সাদত হাসান মানটোর সেই হৃদয়বিদারক গল্প ‘খোল দো’ কার না মনে পড়ে! দিন দুই আগে আমার প্রিয় কথাশিল্পী আনোয়ার শাহাদাতকে বলছিলাম সেই ‘খোল দো’ গল্প পড়লে এখনও কেমন বুকের মধ্যে জমে ওঠে কান্না, প্রথম পড়ার পঞ্চাশ বছর পরও !

এবিষয়টা একেবারেই ভুলে থাকি, কিন্তু হঠাৎ গত কিছুদিন ধরে মোরশেদ ভাইয়ের ‘হাওয়ার গায়ে লেখাজোখা’ হাজার কাজের মাঝে একটু একটু করে পড়তে গিয়ে আমার জন্মভূমির হাজারটা সমস্যা এবং এর বুদ্ধিজীবীদের কথা মনকে এত বেশি কষ্ট দেয়! এঁরা কি সবাই সেই কড়াইয়ের ব্যাঙ বা কনডিসনড রিফ্লেক্সের শিকার? কে জানে! হয়তো বিধাতা জানেন! তবুও এঁদের জন্মদিনে এত হাজার হাজার বন্ধু পাগলের মত হুমড়ি খেয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন কী করে! কষ্ট হয় না তাঁদের!

কয়রকদিন আগে আমার প্রিয় বন্ধু রওশন জামিলের একটি স্ট্যাটাসের জবাবে আমি বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবীর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম মানুষটির রাজনীতির সঙ্গে দ্বিমত করলেও তিনি সৎ বুদ্ধিজীবী, যা আমাদের দেশে বিরল! বলেছিলাম, ‘একজন বুদ্ধিজীবী সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ না করেও সৎ থাকতে পারেন।’ তাতে আমার এক প্রিয় লেখক/ ছড়াকার কিছুটা দ্বিমত করে একটু কৌতুক মিশিয়ে জবাব দিয়েছেন ‘মারহাবা’ বলে। বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। তাহলে কি আমাদের লেখকরা বুদ্ধিজীবীর যে সংজ্ঞা দেন আমি সেটা বুঝতে পারি না! হতে পারে আমার কথাটি তাঁর মনে কৌতুক সৃষ্টি করেছে!

আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে পড়া একটি কথা মনে পড়লো! আমার প্রিয়তম ইতিহাসবিদদের একজন ফ্রাঙ্ক মোরেজ তাঁর বিখ্যাত বই Witness to an Era- 1920-73 এ লিখেছিলেন Jinnah was intellectually the most honest politician in India during his time.বাক্যটি পড়ে প্রায় কিশোর বয়সে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি তখন নেহেরু-গান্ধীর ভীষণ অনুরাগী ইতিহাস পাঠক! আর জিন্নাহকে ভীষণ ঘৃণার চোখে দেখি। কয়েক দশক পরে নিউইয়র্কের নিউস্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বছর কয়েক ঘাম ঝরিয়ে কিছুটা বুঝেছি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বুদ্ধিজীবীকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। শতাংশ বুঝতে পারি আমার ঢাকার বন্ধুরা অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত করেন কেন, কী কারণে আমি মধ্যরাতের নির্বাচনকে ঘৃণা করি!

হতে পারে আমারই ভুল! আমার বন্ধুরা, মানে ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা কি বিষ্ণু দে’র কবিতার সেই পরিস্থিতির শিকার, তাঁরা কি শুধুই অভ্যাস মতো ঘুরছেন ফিরছেন লিখছেন এবং বেঁচে আছেন! জানি না ! বিধাতা জানেন তাঁদের কি দায়িত্ব !

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন