নিউইয়র্ক     রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাকন রেজা

একটা জীবনের খোঁজে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
একটা জীবনের খোঁজে

ঘরকুনো মানুষদের নানা জ্বালা। তারা প্রায় অদৃশ্য শ্রেণির। আমিও গত বারো বছরে বলা যায় অদৃশ্য হয়ে গেছি। এক যুগ কিন্তু দীর্ঘ সময়। আছি পুরো একটা প্রজন্মের দর্শন রহিত অবস্থায়। অদৃশ্য তো বলাই যায়। এর মধ্যে চার বছর কদাচিৎ কোনো আড্ডা-অনুষ্ঠানে হয়তো গেছি। না, বের যে হইনি তা নয়। একা বেড়িয়েছি। যখন সময় অসহ্য হয়ে উঠেছে তখন গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছি। একা। সম্পূর্ণ একা শারীরিক ও মানসিক ভাবে।

আজো বেরিয়েছি। স্টিয়ারিংয়ে হাত। পথের স্পন্দন টের পাচ্ছি। শুরুতে কদাচিতের বিষয়ে একটু মিথ্যে বলেছি। আড্ডায় যাই না যে তা নয়। এই যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা টংয়ের দোকান। চা খাবো, মিশে যাবো মানুষের আড্ডায়। টংয়ের চা দোকানের আড্ডাগুলো বড় অদ্ভুত। অভিজাত কফি শপের সাথে যার কোনো মিল নেই। কফি শপে থাকে প্রদর্শনবাদ আর টংয়ের দোকানে সরল জীবন। আমি মূলত জীবন খুঁজি। যে শ্রেণিতে আমার বাস সেখানে জীবন অনুপস্থিত্। সেখানে আর্ট-কালচার রয়েছে কিন্তু জীবন নেই। আমি একটা সরল জীবন খুঁজি। পথে পথে ঘুরি ঘরকুনো অথচ এক বিবাগী মানুষ।

২ . একটা পাখি উড়ে গেলো, ধোঁয়ারা যেমন যায়। আমার সামনে চায়ের গ্লাস। ধোঁয়া উড়ছে। সাথে উড়ছে ফেলে আসা মেকি জীবন। টং দোকানে কাপ দেয় না, গ্লাসের চা। রঙহীন গ্লাস চায়ের রঙে রঙিন। অভিজাত মানুষেরা যেমন। টংয়ের দোকানের সামনে একটা চেয়ারও ফাঁকা নেই। আলাপ চলছে, নির্জলা জীবন। কোনো আর্ট-কালচার নেই, রাজনীতি আছে। কিন্তু তাতে তত্ত্ব-তালাশ নেই। আমার গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা। গাড়ি সাথে থাকলে দোকানের মানুষগুলো একটু অন্য চোখে তাকায়। ঠিক বৈরিতা নয়, বিরক্তির চোখে। আমার এক বান্ধবীও খুব বিরক্ত হয়েছিলো এক কফি শপে। সাধারণ টি শার্ট আর জিন্স পরেছিলাম বলে। টংয়ের দোকানে তার উল্টো বিরক্তি, কিন্তু প্রত্যাখান নেই। যেমন ছিলো আমার বান্ধবীর চোখে। সেই চোখ মানুষ মাপেনি, পোশাক মেপেছিলো। টংয়ের দোকান মানুষ মাপে, পোশাক নয়।

৩ . কফি শপে কফি পান করতে হয় কায়দা করে। তৃপ্তি উড়ে যায় আত্মা থেকে। টংয়ের দোকানে চায়ে কোনো কেতাদুরস্ততা নেই। সেখানে পান বলার শুদ্ধতা নেই। ফুঁ দিয়ে শব্দ করে খান, কেউ বলবেন না, ‘কী হচ্ছে এটা, শব্দ করে খাচ্ছো কেন?’ এখানে তৃপ্তিটা আত্মার সাথে জুড়ে থাকে। একটা ছেলে, বয়স কুড়ি হবে। চায়ে ডুবিয়ে টোস্ট খাছে। খাওয়ার আনন্দে জ্বলজ্বল করছে চোখ। দু’টাকা দামের একটা মাত্র টোস্টে তার চোখে সুখের আগুন। কফি শপের দু’হাজার টাকার বিল যার কাছে নস্যি। টোস্টের একটা অংশ ভেঙে পড়ে গেলো গ্লাসে। কুচ পরোয়া নেই। চায়ের চুমুক শেষে আঙুল দিয়ে টোস্টটুকু বের করে চোখ বন্ধ করে গিলে ফেলা। আহ, আত্মতৃপ্তি বোধহয় একেই বলে। কোনো ভনিতা নেই, নেই মেকি ভদ্রতা। আমি একটা জীবন খুঁজি ভনিতা ও মেকি ভদ্রতাবিহীন।

৪ . এক যুগ আগে। শহরের এক অভিজাত কফি শপ। কাপুচিনো কফি। সে এলো। ঝাঁঝালো পারফিউম, নাম জানি না। মাথা ধরে আসছিলো। না, বলা যাবে না, বলাটা অভদ্রতা। ভালোবাসা নয় এখানে শেয়ার হয় ভদ্রতা, আদব-কায়দা। বুকহীন ‘বুক’ করা টেবিল, আর কিছু নয়। কফি কাপে আলতো চুমুক। প্রতি চুমুকের শেষে ঠোঁটের রঙ ঠিক আছে কিনা দেখার চেষ্টা। জীবনের রঙ ফিকে হয়ে আসুক আপত্তি নেই, লিপিস্টিকের রঙ যেন ঠিক থাকে। সাথে মেকি হাসি। কায়দা করে হাসার সাথে বসতেও হয়। পোশাকের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে অন্যথায়। কথা বলতে বলতে অসংখ্য প্রচেষ্টা ছিলো পোশাকের ভাঁজ ঠিক রাখার। এদিকে আমার ভ্রুয়ের ভাঁজ যে কুচকে যাচ্ছে তা দেখার ফুসরত কই তার।

না, মেকি জীবনের ফুসরত নেই। নানা ঝক্কি। পোশাকের ভাঁজ, ঠেঁটের রঙ, চোখের মাশকারা, নকল ভ্রু সামলাতেই সময় পার। পাশের মানুষটাকে সামলানো, সেই বাড়তি ঝামেলা কে নেয় বলুন! সুতরাং স্বাধীনতার কথা বলা। স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষের কনসেপ্টটা তুলে আনা। বলা, বড় হও, নিজেকে সামলাতো শেখো। একা একা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো। সেই থেকে আজ বারো বছর, এক যুগ, একাই দাঁড়িয়ে আছি। সম্পূর্ণ একা, শারীরিক ও মানসিক ভাবে। একা একা খুঁজে ফিরি টংয়ের দোকান, ধোঁয়া উঠা চা। উড়ে যাক নকল ভ্রু, চোখের মাশকারা, মেকি জীবন ধোঁয়ার সাথে, ধোঁয়ার মতন। তারপর গাড়িটা ছুটে যাক আবার কোনো নতুন পথে, একটা সরল জীবনের খোঁজে।

শেয়ার করুন