নিউইয়র্ক     বুধবার, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইটস্ অভার

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০২:২৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:২৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ইটস্ অভার

অদিতি যে আরামদায়ক চেয়ারটাতে বসে আছে, তার পূর্বমুখী জানালার বাইরে সবুজ গাছপালার মহিমান্বিত দৃশ্যটি নজর কাড়ার মতো। অটামের পাতার রঙ গাছ এবং গুল্মগুলির সবুজ পাতাকে হলুদ, কমলা, লাল, বেগুনি এবং বাদামী রঙের ছায়ায় দখল করে নিয়েছে। এই সময়ের পাতা ও পাতাদের রঙ’কে বলা হয়-পতনের পাতা, পতনের রঙ। সেই পতনের পাতাদের ডালের উপর বসে আছে-একটি পাখি। সাদা ছোপে কালো পালকের শরীর আর মাথায় লাল ক্রেস্টযুক্ত কাঠঠোকরা’কে, কে না চেনে!

বসার কক্ষের পরিবেশটাও অদিতির খুব পছন্দ। প্রকৃতি-ভিত্তিক কিছু শিল্পকর্ম দেয়ালে ঝুলানো। হেলমেনের দক্ষতার বিজ্ঞাপনে তার ডিপ্লোমাগুলি কক্ষের দেয়ালের এক কোণে ঝুলে আছে। তার পরিষ্কার, বিশৃঙ্খলামুক্ত ডেস্কটি সব সময়ই অদিতিকে খোলামেলাতা এবং স্বাচ্ছন্দের অনুভূতিতে যোগ করে।

-হেলো অদিতি! হাউ আর ইউ?

ছয় ফুট উচ্চতায় সুঠাম দেহী হেলমেন কক্ষে প্রবেশ করতেই হাসি ফুটে উঠলো অদিতির মুখে।

-আমি ভালো আছি।

-চুল কেটেছো? তোমাকে বেশ লাগছে। নাইস হেযারস্টাইল।

-থ্যাংকিউ।

-তো,আজ কী মনে করে এখানে আসা? বলো!

-এমনি!

-তাই? ঠিক আছে!

হেলমেন তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা প্রধানত অনুসন্ধানী ব্যক্তি হয়ে থাকেন, কৌতুহলীও বটে। ‌অদিতি জানে, এখন সে আসল কারণটা খোঁজে বের করার চেষ্টা করবে। কৌশলে তার চোখ, হাত-পায়ের দিতে নজর রাখবে। কত সেকেণ্ডে কতবার তার আইবল নড়ছে, হাত-পা দোলছে, নিঃশ্বাসের গতিবেগ…সব দিকে নজর রাখবে। এই বিষয়টা অদিতির কাছে খুব বিরক্ত লাগে। তবু তার মন খিটমিটি করছে, কথাটা বলতেই হবে।

-মিস্টার হেলমেন!

-ইয়েস!

-লাস্ট বিজিটে তোমাকে বলেছিলাম না ম্যাকেন এর কথা?

-হ্যাঁ! নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?

-আই স্টপড্ হার ফ্রম বিইং মিন টু মি।

-রিয়্যালি?

-ইয়েস!

মিস্টার হেলমেন লক্ষ্য করলো, অদিতি হাত দুটো জড়ো করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভঙ্গিতেই কথা বলছে সে। কলিগ বন্ধুর সাথে ঠিক কী হয়েছে নতুন করে তা জানতে হবে। তবে হেলমেন জানে, বিষয়টা তাকে পীড়া দিচ্ছিল দীর্ঘদিন। কর্মক্ষেত্রে ভীষণ অ্যাংজাইটিতে পড়েছিল অদিতি। প্রথম যেদিন সে হেলমেনকে ভিজিট করতে আসে, বলেছিল, পাশের ডেস্কে বসা কলিগ ম্যাকেনের অদ্ভুত সব আচরণের কথা। তার ইশারা ইঙ্গিতে নানান কটুক্তি, আঘাতমূলক কথা অদিতিকে হতাশায় ফেলেছিল। এক সময়, ভোর হতেই কাজে যাবার তাড়া নয় বরং এক ধরণের আতঙ্ক তাকে ঘিরে ফেলতো! আজ না জানি আবার কি বলে ম্যাকেন-এই ভীতি নিয়েই বাসে চড়ে কাজে যেতো। একপর্যায়ে, অ্যাংজাইটি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আর তখনই ‌অদিতির মা তাকে নিয়ে আসেন সাইকিয়াট্রিস্ট ড্যানিয়েল হেলমেন এর কাছে।

-আবার কিছু হয়েছে কী অদিতি?

-হ্যাঁ। পরশু আমাকে বলল, আমি নাকি ভণ্ড মানুষ।

-কেন বলল এমন কথা?

-তার ধারণা আমি বস কে পটিয়ে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানাজার হতে চাচ্ছি। কিন্তু আমি সত্যিই এমন কিছু করছি না।

-শান্ত হও। ইটস্ ওকে। সবাই ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

-কিন্তু আমি খুব চাপ অনুভব করি তার কথায়।

-এটাও স্বাভাবিক। আচ্ছা বলো তো, সে কী রাগ হয়ে এসব বলে? নাকি খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে?

-স্বাভাবিকভাবে বলে। তাকে কখনো রাগ হতে দেখিনি।

-আচ্ছা! তারপর?

-তারপর আমার খুব রাগ হলো। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। মনে হলো পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, খুব বেশি রাগ হচ্ছিল তাই বলেছি, ‘ইউ নিড টু স্টপ! ইটস্ অভার! ইউ আর সিক!

-তোমার রাগ হবার যথেষ্ট কারণ আছে অদিতি। তবে কিছু শব্দ ব্যবহারের আগে আমাদের ভেবে নেয়া দরকার। কাউকে ‘সিক’ বলা কী তোমার কাছে উপযুক্ত মনে হয়?

-না!

-তোমার কি এখন খারাপ লাগছে অ‌দিতি?

অদিতি কিছু বলছে না। তাকিয়ে আছে সে দেয়ালের চিত্রকর্মটির দিকে। হেলমেন শান্ত এবং সতেজ একটা পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছে তার কক্ষে। ক্লায়েন্টদের মধ্যে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়াকে উন্নীত করতে হেলমেন মানব আচরণের সাথে সাথে নকশা নীতিগুলির উপরও যে মনো্যোগ দেন, তা তার কক্ষের দেয়ালে ঝুলন্ত জলছাপ চিত্রগুলো দেখলেই বোঝা যায়।

এই মুহূর্তে অদিতি তাকিয়ে আছে কক্ষের দেয়াল চিত্র ‘মুন সি ওশ্যান ল্যান্ডস্কেপ’-এর দিকে। এটি তার খুব পছন্দের একটি দেয়ালচিত্র।

-আচ্ছা মিস্টার হেলমেন! ‘মুন সি ওশ্যান ল্যান্ডস্কেপ’- ছবিটি কী রিপ্রেজেন্ট করে?

-এটা বুঝি খুব পছন্দ তোমার?

-হ্যাঁ!

-দেখো, সূর্য এবং চাঁদ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তাদের সকলের মধ্যে একটি সাধারণ জিনিস হল তাদের মেরুতা। সূর্য দৃঢ়তা, শক্তি এবং শক্তির প্রতীক, আর চাঁদ প্রশান্তি, সৌন্দর্য, লালন-পালনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর মহাসাগর হল পৃথিবীতে জীবনের সূচনা, এবং নিরাকার, অগাধ, বিশৃঙ্খলার প্রতীক। সমুদ্রকে স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসাবেও দেখা যেতে পারে, কারণ এটি বহু শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

-বাহ! তুমি তো সাইকিয়াট্রিস্ট না হয়ে আর্টিস্ট হতে পারতে মিস্টার হেলমেন!

-হা হা! তা-ই?

-ইয়েস ইয়েস! হা হা!

ঘড়ির দিকে তাকালো হেলমেন। ৩০ মিনিট পার হয়ে গেছে। এতক্ষণ আলোচনার মধ্যে এই প্রথম অদিতিকে হাসতে দেখল হেলমেন।

-অতিদি!

-ইয়েস মিস্টার হেলমেন!

-ম্যাকেন কে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টায় তুমি যা করেছে বা বলেছো, তাতে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই কখন থামতে হবে, কোথায় দাড়ি, কমা টানতে হবে। আমাদের প্রতিটা মানুষের ভালোবাসা সম্মান পাবার অধিকার আছে এবং আমরা তা পেতে যোগ্য। তুমি তাকে আঘাত করোনি, বরং সে তোমাকে গ্রহণ করতে পারেনি। এটা তোমার অপরাধ নয়। আমাদের কখনোই নির্যাতিত হতে অন্যকে সুযোগ দেয়া উচিত নয়। বুলিং, কটাক্ষ, তিরস্কার, অপমানজনক শব্দ-বাক্যের ব্যবহার-মানসিক স্বাস্থ্যকে সঙ্কটে ফেলে এবং আমরা কেউ তা চাই না। সে যেমন আছে, তাকে তেমন থাকতে দাও। বরং আমরা বিকল্প কিছুতে মনোনিবেশ করবো।

অদিতি অবাক হলো। হেলমেন কী করে জেনে গেল তার মন খারাপ হয়েছে? অপরাধবোধ হচ্ছে?

হ্যাঁ! তার সত্যিই মন খারাপ হয়েছিল। ‘সিক’ বলেছিল ম্যাকেনকে। ঠিক করেনি। তাছাড়া দীর্ঘ ৭ বছর যাবত কাজ করছে সে ওডসাইডের লোকাল ব্যাংকটিতে। এতো এতো কর্মচারী, গ্রাহক-কারো সাথে কখনো কোন মতবিরোধ হয়নি তার। সবসময় পেশাগত মান ও নিয়ম-রীতি মেনেই পথ চলেছে সে। কাজের দক্ষতায় খুশি হয়ে ব্যাংক ম্যানেজার ইঙ্গিতও দিয়েছে তাকে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার করার। বলেছিল ম্যানেজার, অদিতি! ইউ ডিজার্ভ ইট।

ম্যাকেন কাজে যোগ দেয় দুই বছর হলো। শুরুতে ম্যাকেন চুপচাপ থাকতো, তেমন কারো সাথে মিশতো না। অদিতিই প্রথম তার সাথে পরিচিত হয়। তারপর একটা সময় তাদের সম্পর্কটা গড়ে উঠে বন্ধুর মতো। প্রায়শয়ই তারা এক সাথে মধ্যাহ্নভোজ করতো, শপিং করতো। কাজের ফাঁকে ফিসফিসিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো।

হঠাৎ কী হলো! ম্যাকেন, অদিতির সাথে অদ্ভুত রকমের আচরণ করতে শুরু করলো। অদিতির ছোট ছোট যেসব কাজ তাকে খুশি করতো, সেসব কাজই তার বিরক্তির কারণ হতে লাগলো। সুযোগ পেলেই দোষ ধরা, কটাক্ষ করা যেন ম্যাকেন এর অভ্যাসে পরিণত হলো। সমস্যা শুরু হলো যখন বস অদিতির কাজগুলোর প্রশংসা করতে শুরু করলো। অফিসে কঠোর পরিশ্রম করে অদিতি। তাই বস তার প্রশংসা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেননা। এটাই হয়তো ম্যাকেনের বিরক্তির কারণ।

ম্যাকেনের এমন আচরণে অদিতির মধ্যে এক ধরণের ভয় বেড়ে গেল। কাজে যাওয়ার আগ্রহ হারাতে লাগলো। ব্যাংকের দরজা খুললেই মনে হতো, এই বুঝি ম্যাকেন কিছু একটা বলতে আসছে। এই বুঝি নতুন কোন অভিযোগ করতে আসছে! দিন দিন কর্মক্ষেত্রে অদিতির অস্থিরতা বাড়ছিল, কাজে মনোযোগ দেয়া মুশকিল হচ্ছিল। তাই সে ২ মাসের ছুটি নেয়।

কিন্তু ছুটি থেকে ফেরার পরও ম্যাকেনের আচরণ একই রকম ছিল। তাই সেদিন বাধ্য হযে অদিতি খুব কঠোরভাবেই ম্যাকেন কে জবাব দিয়েছিল।

-অদিতি! কিছু বলবে? আমাদের সেশন প্রায় শেষ।

হেলমেন হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো।

-সরি ফর দ্য ওয়ার্ড(সিক)!

-ইটস্ ওকে। তুমি বুঝতে পেরেছো। সি ইউ ইন নেক্সট ভিজিট অদিতি।

-থ্যাঙ্কিউ।

শেয়ার করুন