নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তানের অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৫৯ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৫৯ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তানের অর্থনীতি

মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে পাকিস্তান। ছবি : সংগৃহীত

নজিরবিহীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পাকিস্তান। এক ডলার এখন ২৫৫ পাকিস্তানি রুপিতে বিনিময় হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। জ্বালানি সংকটে ভেঙে পড়ছে টেক্সটাইলসহ অন্যান্য উৎপাদন খাত। ভয়াবহ হারে বেকারত্ব বাড়ছে।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে জনসংখ্যার দিক থেকে পঞ্চম স্থানে থাকা দেশটির অর্থভাণ্ডারে মাত্র ৩০৯ কোটি ডলার অবশিষ্ট রয়েছে। তা দিয়ে তিন সপ্তাহের বেশি খরচ চালানো সম্ভব নয়। পরিস্থিতি অনেকটা শ্রীলঙ্কার মতোই। কার্যত দেউলিয়া ঘোষণার ঠিক আগের ধাপে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানকে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা। তার মধ্যে রয়েছে- ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), বিশ্বব্যাংক এবং সৌদি আরব। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ফ্রান্সও এ সহায়তায় অংশ নেবে। তবে এ অর্থপ্রাপ্তিতে সময় লাগতে পারে।

তাই ঋণদাতা বৈশ্বিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে দ্রুত ঋণ চেয়েছে পাকিস্তান সরকার; কিন্তু তা পেতে বেশ কিছু শর্তপূরণ করতে হবে। যে কোনো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষেই সেই শর্ত পুরোপুরি মেনে চলা কঠিন। তবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শেহবাজ শরিফ সরকার এ অবস্থায় আইএমএফের চাপানো শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

সম্প্রতি আইএমএফের শর্ত মেনে জ্বালানি তেলের দাম বিপুলভাবে বাড়িয়েছে পাকিস্তান। পেট্রল এবং ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৩৫ টাকা। এর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার পাকিস্তানের। তা না হলে অবস্থা ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাবে, তা অনুমেয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৬.১ শতাংশ কমে মাত্র ৩০৯ কোটি ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, যা প্রায় বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ডলার সংকটের কারণে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য আমদানি করতে পারছে না পাকিস্তান। এমনকি জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে বড়জোর তিন সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্যোগী হয়েছে দেশটি। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাত আটটার পর সব বিপণিবিতান, দোকানপাট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।

পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে নবম পর্যালোচনার পর, অর্থাৎ ৯টি আলোচনার পর দেশটিকে ১১০ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে আইএমএফ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পাকিস্তানের জন্য অন্যান্য দেশ ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও দ্বিপাক্ষিক ঋণের পথকে প্রশস্ত করবে।

আইএমএফ চাচ্ছে, পাকিস্তান সরকার যেন দেশের রাজস্ব বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনৈতিক এবং আর্থিক পরিকাঠামো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় অংশ নেবে আইএমএফ। সংস্থাটি আশা করছে, পাকিস্তান সরকার শিগগিরই দেশের বিশাল ফিসক্যাল গ্যাপ আর্থিক ব্যবধান পূরণে পদক্ষেপ নেবে।

আইএমএফের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ থেকে ৩০ রুপি বাড়ানো। জ্বালানি তেল জাতীয় পণ্যে ১৭ শতাংশ কর বসানো। অথবা প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশের মাধ্যমে জিএসটি হার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ করা।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, সংক্ষিপ্ত বাজেটের মাধ্যমে পাকিস্তান চিনিযুক্ত কোমল পানীয়ের আবগারি শুল্কের হার ১৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউ সিগারেটের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া, বেশি বেতনের সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের তথ্য চেয়েছে দেশটির রাজস্ব বোর্ড। এই তথ্য ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউ এবং ব্যাংক পর্যালোচনা করবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ আবিদ হাসান সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘আমরা পথের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছি; কিন্তু আইএমএফের দাবি পূরণের জন্য সরকারকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। যদি তা না করা হয়, তা হলে পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

শ্রীলঙ্কা গত বছর দেউলিয়া হয়ে যায় এবং কয়েক মাস যাবৎ খাদ্য এবং জ্বালানি ঘাটতিতে পড়ে। যার ফলে বিক্ষোভের জন্ম দেয় এবং দেশটির নেতারা পদত্যাগ করতে এবং দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের অবস্থাও খুব ভালো নয়। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশটির কাছে মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে।

এমন মুহূর্তে পাকিস্তানের সামনে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য এবং ওষুধ আমদানি করার কোনো বিকল্প নেই। আমদানি নিষেধাজ্ঞা এবং রুপির দরপতনে কারখানাগুলো বন্ধপ্রায়। নির্মাণ কাজগুলো থেমে আছে, পোশাক কারখানা বন্ধ এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য পণ্যের অত্যধিক দাম, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানে আগে থেকেই অর্থনৈতিক সংকট চলছিল। করোনা মহামারি আর গত বছরের বন্যা এ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। অনেক জায়গায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সেই সঙ্গে মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানের রুপির ক্রমাগত দরপতন অব্যাহত রয়েছে। দেশটির এই সংকট এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ, দেশটির দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

পাকিস্তানে ডলারের তীব্র সংকটে পণ্যবাহী হাজারো কন্টেইনার সমুদ্রবন্দরগুলোতে আটকে আছে। হাজার হাজার মানুষ খাদ্য-বস্ত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছেন। প্রত্যেক দিনই পণ্যসামগ্রীর দাম হু-হু করে বাড়ছে, সবকিছু চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে বেকারত্ব বরণ করছেন কোটি কোটি মানুষ। পাকিস্তানের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি টেক্সটাইল শিল্প ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

করোনা ভাইরাস মহামারির পর রপ্তানি হ্রাস এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার কারণে পাকিস্তানে ৭০ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। যাদের মধ্যে অর্ধেকই নারী। বহু কারখানা জ্বালানি ও কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে আরও বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।

এদিকে, পাকিস্তানে বেকারত্ব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন অনেক তরুণ অর্থনৈতিক সংকটের জেরে পাকিস্তান ছাড়ছেন। গত বছর আট লাখের বেশি তরুণ চাকরির সন্ধানে পাকিস্তান ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক ব্যুরো। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল বছরে ৬ লাখ ২৫ হাজার ৮৭৬। তার আগের বছর পাকিস্তান ছাড়েন আরও কম ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৩৯ জন।

এ বিষয়ে পাকিস্তানের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও বিশেষ উদ্যোগ বিষয়ক মন্ত্রী আহসান ইকবাল বলেন, ‘শিক্ষিত তরুণদের এভাবে দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। এ সংখ্যা কমিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের। সেই সঙ্গে তরুণদের দেশেই যথাযথ কাজের পরিবেশ দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তাই আশা করা হচ্ছে, এতে মেধাবী তরুণদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা কমবে।’

গত বছরের জুনে গ্যালাপ পাকিস্তান ও গিলানি ফাউন্ডেশনের এক যৌথ জরিপে দেখা গেছে, ৩০ বছরের নিচে বয়স এমন প্রতি তিনজন পাকিস্তানির একজন বিদেশে গিয়ে চাকরি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা তরুণদের মধ্যে এই হার ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান গ্যালাপ পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক বিলাল গিলানি। সূত্র : সাম্প্রতিক

শেয়ার করুন