নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডলার বিক্রির চাপেই বাড়ছে না বাংলাদেশের রিজার্ভ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:০৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:১৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ডলার বিক্রির চাপেই বাড়ছে না বাংলাদেশের রিজার্ভ

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় কমছেই। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও বেশ ভালো। রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এরপরও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর এক মাসের বেশি সময় এই সূচক ৩১ দশমিক ১ থেকে ৩১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। বাজারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের আকুর বিল শোধ করতে হবে। এর মধ্যে যদি আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া না যায়, তাহলে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে বলে মনে করছেন তারা।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার বড় অবদান ছিল। আমদানি কমায় এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের উল্লম্ফনের কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে (২০২০-২১) রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা রিজার্ভকে স্ফীত করেছিল।

কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেখা যায় ঠিক উল্টো চিত্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় বাড়লেও রিজার্ভের অন্য দুই উৎস রেমিট্যান্স ও বিদেশি ঋণ কমতে থাকে। এর ফলে রিজার্ভ নামতে থাকে। বাজারে ডলারের তীব্র সংকট দেখা যায়। হুহু করে বাড়তে থাকে ডলারের দর। ডলারের দামের লাগাম টেনে ধরতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলে পুরো অর্থবছরজুড়ে; সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।

সেই ধারাবাহিকতায় বাজারের চাহিদা মেটাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রায় প্রতিদিনই বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমদিকে সব ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হলেও গত পাঁচ মাস ধরে শুধু সরকারি কেনাকাটায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই অর্থবছরের ৯ মাস ১১ দিনে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ১১ এপ্রিল) সব মিলিয়ে ১১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

গতকাল দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে ৬ এপ্রিল রিজার্ভে ছিল ৪৪ বিলিয়ন ২২ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করলে রিজার্ভ এতটা নিচে নামত না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর। গতকাল টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা ২০ পয়সা। ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল এই বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। এ হিসাবে এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

২০২১ সালের ১২ জুলাই আকুর মে-জুন মেয়াদের প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় দেখা দেয় চরম অর্থনৈতিক সংকট, রিজার্ভ নেমে আসে ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে। পাকিস্তানের রিজার্ভও তলানিতে নেমে আসে। ওই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও রিজার্ভ নিয়ে আতঙ্ক ও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে গড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। কমতে কমতে গত ফেব্রুয়ারিতে তা ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট ৪৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ কম।

অন্যদিকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ৯ মাসের তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি। আর রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

রিজার্ভ কমার কারণ জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ হচ্ছে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই ব্যয় বাড়ার অবশ্য কারণ ছিল, জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। জাহাজ ভাড়া বেড়েছিল দুই গুণ-তিন গুণের মতো। তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, গত বছরের আগস্টে আমাদের রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল, তাতে কিন্তু দর ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো কিনেছিল, তার একটা অবদান ছিল। আর এখন কমতে কমতে যে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, তাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রিও একটি কারণ।’

‘তবে এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আর কোনো উপায় ছিল না’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে ডলার না দিলে বাজারে ডলারের সংকট আরও বেড়ে যেত। তাই আমি মনে করি, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে ঠিক কাজটিই করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানের রিজার্ভ সন্তোষজনক: কোনো ঝুঁকি নেই। তবে এর চেয়ে যেনো বেশি না কমে তার জন্য একদিকে যেমন আমদানির লাগাম টেনে ধরতে হবে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে জোর দিতে হবে।’সুত্র দৈনিক বাংলা

এম,এ,এস/পরিচয়

শেয়ার করুন