নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ১৮ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির কারণে আজিজের নিষেধাজ্ঞা আসছে জানতো বাংলাদেশ সরকার

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪ | ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ | ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দুর্নীতির কারণে আজিজের নিষেধাজ্ঞা আসছে জানতো বাংলাদেশ সরকার

বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ তারা বলছেন, তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অভিযোগ করেছে তা তিনি সেনাপ্রধান থাকা কালেও আলোচিত হয়েছে৷

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে স্থানীয় সময় সোমবার (বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতের পর) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ এর ফলে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না৷ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আজিজ আহমেদ তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন৷ এটি করতে গিয়ে তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন৷ এছাড়া তিনি তার ভাইকে সামরিকখাতে অন্যায্যভাবে কন্ট্র্যাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন এবং সরকারি নিয়োগ দিতে ঘুস নিয়েছেন৷

তবে সাবেক সেনাপ্রধান জার্মান বেতার ডয়চে ভেলের কাছে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে তা আল-জাজিরাসহ দুই-একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলে যায়৷ ওইসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নাই৷ আমি এর আগেও ওইসব অভিযোগের জবাব দিয়েছি৷ ডয়চে ভেলের কাছেও আগে আমি বিস্তারিত বলেছি৷” তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগে আমি মর্মাহত, এটা দুর্ভাগ্যজনক৷ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো প্রমাণ নাই৷”

আজিজ আহমেদ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ২০১৮ সালের ২৫ জুন৷ ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সময়ে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন৷

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আগে জানানো হয়েছে৷ আমরা মনে করি যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা আলোচনার মধ্যে আছি৷”

তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি যেটি ঘোষণা করেছিল, সেটি থ্রি সি ভিসা পলিসি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের আওতায়৷ আর জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে যে ভিসা রেসট্রিকশন দেয়া হয়েছে, সেটি ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অ্যাক্টের অধীনে৷ অন্য অ্যাক্টের অধীনে তাকে ভিসা রেসট্রিকশন দেয়া হয়েছে৷”

তিনি আরও জানান, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে৷ আপনারা দেখেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছে৷ সরকারি দলের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে৷ দুর্নীতি মোকাবিলা এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি৷”

প্রতিক্রিয়া: সাবেক সেনা প্রধানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞায় ডয়চে ভেলের কাছে সাবেক কূটনীতিক, সেনা কর্মকর্তা, রাজনৈতি নেতা এবং নাগরিকরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ তারা এই নিষেজ্ঞার গুরুত্ব, পরবর্তী ফলাফল এবং সরকারের করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন৷

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার বলেন, ‘‘এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত৷ এটা দেশের জন্য ভালো সংবাদ বহন করে না৷ এটা দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন করে৷ তার বিরুদ্ধে প্রধানত দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে৷ তিনি যখন সেনবাহিনীতে ছিলেন, সেনা প্রধান ছিলেন তখন তিনি দুর্নীতি করেছেন বলা হয়েছে৷ তিনি এখন আর সেনাবাহিনীতে নেই৷ তাই এখন আর এর প্রভাব সেনাবাহিনীতে পড়ার কথা নয়৷”

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এল৷ এই অঞ্চলে মিয়ানমার ও পাকিস্তানের জেনারেলদের ওপর এর আগে আমরা দেখেছি৷ তবে এটার নানা দিক আছে৷ সামনে হয়তো দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আসা হয়েছে৷ পিছনে আরো অনেক বিষয় থাকতে পারে, আমরা তো সেটা এখনো জানি না৷ তবে এখন যারা সরকারে আছেন তাদের বিষয়গুলো দেখার কথা৷ তারা যখন দেখবেন তখন আশেপাশের আরো অনেক বিষয় দেখবেন৷ এর সাথে অন্য কারণও থাকতে পারে৷ তিনি এখন সেনাবাহিনীতে নাই৷ কিন্তু তিনি তো সেনাবাহিনীতে ছিলেন৷ সেনাপ্রধান ছিলেন৷ সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি এইসব দুর্নীতি অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ, ফলে এটা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷”

যুক্তরাষ্ট্র যা বলেছে তা সবার জানা: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘তারা স্টেটমেন্টে যা বলেছে এটা মোটামুটি জানা বিষয়৷ তিনি সেনা প্রধান থাকাকালেও তাকে নিয়ে নানা কথা হয়েছে৷ তার পরিবারে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত লোকজন আছেন৷ আর এখানে তো দুর্নীতি আছেই, নতুন কিছু নয়৷ সেক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠান যে বাইরে থাকবে তা মনে হয় না৷ এটা তাই খতিয়ে দেখার কিছু নাই৷”

‘‘এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি তো ক্ষুন্ন হবে৷ আর সেনাবাহিনীর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কী না বলতে পারছি না৷ তবে সেনাবাহিনীকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখা হয়৷ অন্য সরকারি অফিসের মতো দেখা হয় না৷ সেই বিবেবচনায় এটা তাদের ভাবমূর্তির জন্য তো খানিকটা ক্ষতিকর বটেই৷ যখন একজন সাবেক সেনাপ্রধানের দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে৷” বলেন তিনি৷

তিনি জানান, ‘‘ডোনাল্ড লুর সফরে সরকারি শিবিরে যে উল্লাস দেখা দিয়েছিলো যে না সবকিছু পেছনে চলে যাচ্ছে আসলে বিষয়টি সেরকম না৷ কারণ তিনি ঢাকা সফরের সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা যেমন বলেছেন তেমনি কিছু হার্ড ইস্যু-এর কথাও বলেছেন৷ ফলে তারা সেই বিষয়গুলো নিয়েও এগোচ্ছে৷ তবে আজিজ সাহেবসহ দুই-চারজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলেই যে রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়ে যাবে তা আমি মনে করি না৷”

‘‘একটি বিষয়ে আমি অবাক হয়েছি যে যুক্তরাষ্ট্র তো বলেছিলো নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যাকে দেয়া দেয়া হবে তিনি জানবেন এবং তারা জানবে৷ তাহলে এটা প্রকাশ করে তারা কি আলাদা কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে৷ এর আগে অবশ্য র‌্যাবের ১০ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয় তারা প্রকাশ করেছিলো, সেটা ছিলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায়, বলে জানান তিনি৷

সরকারের ওপর চাপ আরো বাড়বে: বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা মনে করেন, ‘‘সাবেক সেনা প্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একটা ওয়েক আপ কল৷ সরকারের ওপর চাপ আরো বাড়বে সামনে৷ তাদের আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বলেনি যে তারা এখন আর গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবে না৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করবে না৷ তারা যে এটা নিয়ে সব সময়ই কাজ করছে এটা তার প্রমাণ৷ আর এটা আমাদের জন্য নতুন একটা দিক এই কারণে যে এই প্রথম সাবেক একজন সেনা প্রধানের দুর্নীতির বিষয় প্রকাশ করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ এতে একটা বিষয় স্পষ্ট হলো যে বাংলাদেশে যে দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্বাচন, গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য দায়ী তাদের তারা ছাড় দেবে না৷ আর যারা এরসঙ্গে যুক্ত তারাও এবার চাপে পড়বেন, কারণ তারা অবসরের পর স্ত্রী সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে থাকতে চান৷ তারা তো আর উগান্ডা যাবেন না৷ সেই পথ তাদের বন্ধ হয়ে যাবে৷ এখন দেখার বিষয় আরো কত বড় বড় রাঘব বোয়াল ধরা পড়ে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, গণতন্ত্রের শত্রু এটা সরকার এবং তাদের জন্য এলার্মিং বলে জানান তিনি৷

এই সরকারকে অ্যামেরিকা একদমই পছন্দ করে না: নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘আসলে সরকার যে চাপে আছে সেটা সরকার জানে৷ ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে সরকারের কিছু স্টুপিড লোক উল্লাস দেখাচ্ছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ডোনাল্ড লুকে সাক্ষাৎ দেননি৷ এ থেকেই পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়৷ সাবেক সেনা প্রধানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা কী হবে তা আমি এখন আলাপ করছি না৷ তবে মানুষের মধ্যে একটা বিরাট ভাব আসবে যে এইতো আবার শুরু হয়েছে৷ পারবে না সরকার৷ মানুষের মধ্যে একটা চাঙ্গা ভাব আসবে, রাইট অর রং৷”

তিনি বলেন, ‘‘তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে দীর্ঘসূত্রিতা তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না৷ আমরা মনে করি শেষ হয়ে গেছে, আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মতো৷ কিন্তু ওরা ছাড়ে না৷ ওরা দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে৷ ওরা সম্পর্কও এগিয়ে নিয়ে যায়৷ তারমধ্যেই আবার ব্যবস্থা নেয়৷ আমাদের এখানেও তাই হবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘তবে যারা মনে করে এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের দুয়ার খুলে যাবে তারা ভুলের মধ্যে আছে৷ গণতন্ত্রের জন্য আমাদের নিজেদেরই কাজ করতে হবে, আমি মনে করি যে অ্যামেরিকা এখনই এই সরকারকে সরিয়ে দেবে সেরকম লক্ষণ নাই৷ তবে অ্যামেরিকা যে এই সরকারকে একেবারেই পছন্দ করছে না সেটা বোঝা যায়৷”

দুর্নীতি এখানে এখন স্বাভাবিক ঘটনা:ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, ‘‘সাবেক সেনা প্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা একটা বার্তা যে যারা দুর্নীতি করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার যারা করেন তারা যেকোনো পরিচয় বা অবস্থানেরই হোক না কেন জাতীয়ভাবে যেমন আইনের আওতায় জবাবদিহিতার বিষয় আছে তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, আর এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক অবস্থানেই হোক, শাসন ব্যবস্থায়ই হোক ক্ষমতার ওপর ভর করে দুর্নীতি করা , মানুষের অধিকার হরণ করা এটা স্বাভাবিক বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে তাদের দিক থেকে৷ কিন্তু যার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছে তার অবস্থান বা পদ পদবি বিবেচনায় না নিয়ে দেশের ভেতর থেকেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার৷ তিনি এককভাবে এটা করেছেন বলে আমি মনে করি না৷ তার সঙ্গে আরো যারা আছেন তাদেরকেও চিহ্নিত করা একটা চ্যালেঞ্জ৷ আর রাজনৈতিভাবেও সরকারের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ৷

তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতো তথ্য প্রমাণ হাতেই নিয়েই এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷ একজন সাবেক সেনাপ্রধানের ব্যাপারে তাদের এই অবস্থান অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা৷”-হারুন উর রশীদ স্বপন, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে, ঢাকা

শেয়ার করুন