২০২১ সলের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্যঘাটতির দেশ থেকে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে৷
এদিকে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ১ কোটি ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন খাদ্য আমদানি করেছে৷ ২০২২ সালে আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে এক কোটি চার লাখ ৪৯ হাজার টন ছিল৷ ২০২৩ সালেও আমদানির পরিমাণ কাছাকাছি ছিল৷
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি না বলতে পারব না, তবে আমরা চালের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ৷” তাহলে প্রতিবছর কেন চাল আমদানি করতে হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘২০-২৫ জন ব্যবসায়ী আছেন যারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তাদের কাছে ২-৩ বছরের পুরনো ধানও মজুদ থাকে৷ তারা যদি মজুদ না করেন তাহলে চালের সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ আর সব মিলিয়ে যদি বলি, তাহলে এই ২০-২৫ জনের সঙ্গে আরও সর্বোচ্চ ১০ জন আছেন যারা পুরো খাদ্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তাদের কাছেই জিম্মি পুরো খাদ্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ৷’’
এর সমাধান কীভাবে সম্ভব? খোরশেদ আলম বলেন, ‘‘আমি অনেকবার বলেছি, এখন কিন্তু কৃষিপণ্য কৃষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না৷ কৃষিতে কর্পোরেট গ্রুপ ঢুকে গেছে৷ মেশিন দিয়ে ধান লাগানো যায়, মেশিন দিয়ে ধান কাটা যায়, ফলে সেখানে আর কৃষকের প্রয়োজন নেই৷ এই কর্পোরেট গ্রুপগুলো যদি চালের বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তাহলে তারা চাইলে চালের কেজি ৫০০ টাকাও বানিয়ে ফেলতে পারে৷ ফলে এদের যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে সরকার যে-কোনো সময় বিপদে পড়তে পারে৷’’
কয়েকজন ব্যবসায়ী ধান মজুদ করেন বলে খোরশেদ আলম যে অভিযোগ করছেন, তা নিয়ে কথা হয়জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেরমহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সঙ্গে৷ অভিযান চালানো হয় না কেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘খাদ্যদ্রব্যের এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের৷ তারপরও আমরা খবর পেলে অভিযান চালাই৷ জনবল সংকটের কাছে আমাদের কাছে সবসময় সব খবর আসে না৷ তারপরও যে খবরগুলো পাই সেগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি৷”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাল, মাছ, মাংস ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে৷ এর বাইরে আরও ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে৷
অস্ট্রেলিয়ায় চালের কেজি ৮০ টাকার বেশি: খাদ্যমন্ত্রী
বাংলাদেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দাম বেশি কেন জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘‘আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেলে মার্কেটে ঢুঁ মারি৷ অস্ট্রেলিয়ায় চালের কেজি বাংলাদেশি টাকায় ৮০ টাকারও বেশি৷ সেখানে বাংলাদেশে মোটা চালের কেজি ৫০ টাকার নিচে৷ যদিও তাদের উপার্জনের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আছে৷ তারপরও আমরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছি ৩২ টাকা কেজি দরে৷ দেড় কেজি ধানে এক কেজি চাল হয়৷ সেই হিসেবে পড়ে ৪৮ টাকা৷ তাহলে কি চালের দাম বেশি? এখন আপনি যদি টাকা খরচের জন্য সুপারশপে গিয়ে ৭০ টাকার চাল ১০০ টাকা দিয়ে কেনেন তাহলে এর দায় কে নেবে? আপনি চালের বাজারে যান, ৭০ থেকে ৮০ টাকায় সবচেয়ে ভালো চাল কিনতে পারবেন৷ সেটাই সুপারশপে হয়ে যাচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা৷ কেউ যদি টাকা উড়ানোর জন্য সুপারশপে গিয়ে কিনে তুলনা করে তাহলে তো হবে না৷’’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন কোটি টন চালের প্রয়োজন৷ এর বাইরে আরও অর্ধলক্ষ টন প্রয়োজন মাছের খাবার, পোল্ট্রিফিডসহ আনুসঙ্গিক কাজে৷ তাহলে বাংলাদেশে আসলেই উৎপাদন কত? এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই৷
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতি গবেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টন চাল উৎপাদন করি এটা সত্যি৷ শুধু চালেতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে হবে না, খাবারের জন্যতো আমাদের আরও অনেক কিছুই লাগে৷ আমাদের গমের প্রয়োজন ৭০-৮০ লাখ টন, ভুট্টার প্রয়োজন ৭০-৮০ লাখ টন৷ এগুলোর কি সবটাই আমরা উৎপাদন করি? করি না৷ ফলে প্রতিবছর আমাদের ৪০-৪৫ লাখ টন গম, ২৫-৩০ লাখ টন ভুট্টা আমদানি করতে হয়৷ তবে আমরা গবাদিপশু, মাংস, দুধ, ডিম নিজেরা উৎপাদন করছি৷ কিন্তু দাম অনেক বেশি৷’’
নিজেরা উৎপাদন করলে দাম এত বেশি কেন জানতে চাইলে খান বলেন, ‘‘এখন ডলারের রেট কত? আমদানি করতে হলে তো দাম বাড়বেই৷ আরেকটা বিষয়ও দেখতে হবে, সেটা হলো বিশ্বের মোট জমির শূন্য দশমিক এক শতাংশের মালিক বাংলাদেশ৷ এখানে বসবাস করেন বিশ্বের ২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ৷ এত বেশি মানুষ এত কম জমিতে থাকলে দাম তো বাড়বেই৷ আবার প্রতিবছর শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ কৃষিজমি আবাসস্থলে পরিণত হচ্ছে৷ এতে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে৷ আরেকটা জিনিস দেখেন, বাংলাদেশে বছরে একজন মানুষ ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেন, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে পাবেন না৷ এটাও মূল্যবৃদ্ধির কারণ৷’’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ রিপোর্টে দেখা গেছে, মে মাসে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আবার দুই অঙ্কের ঘর স্পর্শ করেছে৷ মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ৷ আগের মাস এপ্রিলেও তা ছিল দুই অঙ্কের ঘরে, ১০ দশমিক ২২ শতাংশ ছিল৷ চার মাস পর গত এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে ওঠে৷ পরের মাসে তা আরও বাড়ল৷ এদিকে মে মাসে দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারও কিছুটা বেড়েছে৷ মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ৷ আগের মাস অর্থাৎ এপ্রিলে যা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ৷
দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ
এর পেছনে তিনটি কারণ আছে বলে মনে করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনি ধান বিক্রি করে তেল কিনবেন৷ এখন তেলের দাম যদি বেশি হয় তাহলে তো আপনাকে ধানের দামও বাড়াতে হবে৷ এখানে তো একটা জিনিস বিক্রি করে আপনি আরেকটা জিনিস কিনছেন৷ আবার পরিবহণ খরচ একটা বড় বিষয়৷ তেলের দাম যদি বাড়ে তাহলে তো পরিবহণ খরচও বাড়বে৷ যদি পরিবহণ খরচ বাড়ে তাহলে আপনার উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে৷ আর তৃতীয়ত, আমাদের তো ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে৷ ফলে রেশনালি সব জিনিসের দামই বেড়েছে৷’’
আর খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘দেশে উৎপাদন হলেও তেল, সার ও পরিবহনের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ এসবকিছুর আলোকেই মূল্য নির্ধারণ হয়৷ এখন তো ৩২ টাকা কেজিতে ধান কিনছে সরকার৷ ফলে সেই হিসেবে চালের দাম বেশি না৷ কিন্তু বাইরের বাজারগুলো দেখেন, সেখানে চালের দাম কত? এখন যেসব পণ্য আমদানি করতে হয়, সেগুলো তো বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতেই হবে৷’’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাধীনতাপরবর্তী ৫২ বছরে বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ৷ ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে৷ গত ১০ বছরে কৃষির বড় ধরনের বিবর্তন হয়েছে৷ অনেকেই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খামার তৈরি করেছেন৷ এর ফলে উৎপাদনও বেড়েছে৷
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশ এখনও বছরে প্রায় এক কোটি টন খাদ্য আমদানি করছে৷ এত আমদানির পরও কেন বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হচ্ছে? বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘‘আমরা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সেটা কি অর্থে বিবেচনা করছি? এখন শুধু উৎপাদন করলেই তো হবে না৷ কতভাগ মানুষ সেই খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন? কতজন মানুষের সেই খাদ্য কেনার সক্ষমতা আছে? এখন প্রশ্ন হলো, নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের দাম কেন বাড়ছে? এক্ষেত্রে যোগান আর চাহিদার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে৷ ডলার সংকটের কারণে অনেক পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে৷ ফলে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি আছে৷ অনেক সময় যোগানে ঘাটতির জন্যও পণ্যের দাম বেড়ে যায়৷ এখন আমাদের উৎপাদন, আমদানির সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে৷ তা না হলে দিন দিন সংকট বাড়বে৷ সুনির্দিষ্ট কৌশল নিলে অনেকাংশেই বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷’’- সুত্র জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে