নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোলাম মাওলা রনি

রাষ্ট্রক্ষমতার নিষ্ঠুর পাগলামো

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:৫৯ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:৫৯ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
রাষ্ট্রক্ষমতার নিষ্ঠুর পাগলামো

রাজ-রাজড়াদের ক্ষমতার লোভ নিয়ে কাব্য-মহাকাব্যের শেষ নেই। আদিকালের কবে থেকে রাজার জন্ম আবার রাজারা ঠিক কোন দিন থেকে মহারাজা হলেন তার দিনক্ষণ কোনো ইতিহাসবিদ লিখে যাননি। তবে রাজনীতি, রাজ্য এবং রাজধানীর কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে রাজাদের লোভ, প্রজাদের ধন সম্পত্তি লুট করার লিপ্সা এবং বাহারি জুলুম অত্যাচারের নিষ্ঠুর পাগলামোর অসংখ্য কাহিনী ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।

মহাকালের রাজাদের সুশাসক হওয়ার নেপথ্য কারণ যেমন তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সুশিক্ষা ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা লাভের ধারাবাহিকতাকে চিহ্নিত করা হয় তদ্রƒপ কুশাসক হওয়ার জন্য প্রথমেই খোঁজা হয় অমানুষটির জন্মবৃত্তান্ত। তারপর সে কোন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, কী খেয়েছে এবং কী শিখেছে তাও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়। পরিশেষে সব কুশাসকের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যেই অনিয়ম-অনৈতিকতা-নিষ্ঠুরতা-রক্তপাত, ছলচাতুরী ইত্যাদি থাকে। ফলে কুশাসক বা মন্দ রাজারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারে না যে, তারা সত্যিকার অর্থেই রাজা।

এ অবস্থায়, ক্ষমতার চেয়ারে বসে তারা হররোজ এমন সব উদ্ভট কাণ্ড-কারখানা করতে থাকেন যা কি না পাগলামোর চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের লম্ফ-ঝম্ফ, হাঁক-ডাক, জুলুম-অত্যাচার, মিথ্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি, ভোগ-বিলাস, রক্তপাত ইত্যাদির নেপথ্য কারণ হিসেবে নিজেদের অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও অবৈধতা দায়ী করে যুগ যুগান্তরের ইতিহাসবেত্তা-জ্ঞানী-গুণীজন বহু বইপুস্তক রচনা করে গেছেন।

রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে মানুষরূপী অমানুষরা যখন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে উপর্যুপরি পাগলামো করতে থাকেন তখন তাদের জীবনে এমন এমনটি বিশ্বাস পয়দা হয়ে যায় যে, তাদের কথাই আইন- তারা যা বলবে তাই জনগণকে শুনতে হবে এবং তাদের কথার বিরোধিতা করার অর্থই হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাদের মধ্যে এমন এক মানসিক রোগের সৃষ্টি হয় যার কারণে একাকিত্ব তাদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তারা একা থাকতে ভয় পান, রাতগুলো তাদের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে এবং ঘুম রীতিমতো সোনার হরিণে পরিণত হয়। কোনো কুশাসক বা মন্দ রাজার নসিবে ঘুম জোটে না। নির্ঘুম রজনীর বিভীষিকা থেকে বাঁচার জন্য তারা রাতের আঁধারকে আলোকময় করে মদ-নারী এবং বিকৃত যৌনাচারে মেতে ওঠে। ফলে একটি সময়ে তারা বিকৃত রুচির বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়ে পড়েন।

প্রাচীন ভারতে রাজাদের অশ্বমেধযজ্ঞের কথা জানা যায়। কোনো কোনো রাজা নরমাংস ভক্ষণ করতেন। কেউ বা করতেন রক্তপান। অনেকে শিশু হত্যা-কুমারী হত্যা, কুমারী পুঁজা কিংবা শিশু-কিশোরদেরকে নদী বা সমুদ্রে বিসর্জন দিতেন। তাদের নিষ্ঠুরতার দু’টি পর্ব ছিল। প্রথমটি হলো, নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তারা কল্পনার দেব-দেবীকে খুশি করার নিমিত্তে উল্লিখিত কর্ম করতেন। অনেকে আবার নিজেদের স্বাস্থ্য-যৌবন ও শক্তিমত্তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বলিদান-রক্তপাত ইত্যাদি নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে কল্পিত দেব-দেবীর মনোরঞ্জন ঘটাতেন।

নিষ্ঠুরতার দ্বিতীয় পর্বে পাগলা রাজারা সর্বদা প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মূল এবং কল্পিত শত্রু চিহ্নিতকরণ ও নিধনের নামে গণহত্যা চালাতেন। তারা সামর্থ্যবান-বিবেকবান-শিক্ষিত অভিজাত লোকদেরকে জাতশত্রু মনে করতেন। ফলে তাদের রাজ্যে কেবল সেসব লোকই বেঁচে থাকত যারা নিজেদেরকে বিবেকহীন-অশিক্ষিত ও রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছা-রুচি-অভিরুচির কাছে সমর্পণ করতে পারত।
ইতিহাসে যেসব পাগলা রাজা কুখ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন তাদের মধ্যে রোমান সম্রাট নিরো, ক্যালিগুলা, কমোডাস, চীন সম্রাট জিয়া ঝি, ডি জিন, সুই ইয়াং ডি, রুশ সম্রাট আইভান, পিটার দ্য ফার্স্ট, আন্না, প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। অন্য দিকে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে অন্তত ১০ জন ভয়ঙ্কর রাজার নাম বলা যাবে যারা তাদের রাজত্বকালকে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে ফেলেছিলেন, যে তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে রাজা স্টিফেনের নাম। এরপর দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, চতুর্থ হেনরি, তৃতীয় রিচার্ড, অষ্টম হেনরি, প্রথম চার্লস, দ্বিতীয় জেমস এবং অষ্টম এডওয়ার্ডের নাম শুনলে এখনো ইউরোপের লোকজন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।

ভারতবর্ষে পাগলা রাজাদের কুকর্ম শুরু হয়েছিল মহাভারতের যুগ থেকে। ইতিহাসের পরিক্রমায় হাজার বছরের মধ্যে কয়েক শ’ মানবরূপী দানব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রীতিমতো রাক্ষসরাজত্ব কায়েম করেছিলেন, বাংলার রাজা গণেশসহ রাজা গণেশের প্রেতাত্মারা সর্বকালে রাজনীতির যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে তার কবলে পড়ে সব আমলেই বাঙালি নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে সুশাসকদের কল্যাণে পাগলা রাজাদের মন্দকর্ম যেখানে মাটিচাপা পড়েছে সেখানে সুবে বাংলায় ঘটেছে উল্টো। এখানে মন্দ শাসকদের তাণ্ডবে সুশাসকদের সব সুকর্ম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।

রাষ্ট্রক্ষমতায় পাগলা রাজাদের অভিষেকে কী সব লঙ্কাকাণ্ড ঘটে থাকে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। এক পাগলা রাজা দাঁত মাজতেন না। চিকিৎসকরা তাকে বারবার সতর্ক করতে থাকেন। জবাবে তিনি সবসময় বলতেন, বাঘেরা কোনো দিন দাঁত মাজে না। ফলে সেই রাজার বেশির ভাগ দাঁত নষ্ট হয়ে যায় এবং বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, পাগলের একটি দাঁতও নেই। আমি যার কথা বলছি তিনি গত ২০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসক ছিলেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি তখন পৃথিবীর প্রধানতম পরাশক্তি।

পাগলা রাজাদের বিকৃত কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদাহরণ দিই। এক রাজা শস্যক্ষেত ছাড়া মলত্যাগ করতে পারতেন না। তিনি লোকজনকে বলতেন, দীর্ঘদিন গেরিলা যুদ্ধ করে বনে-জঙ্গলে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে গিয়ে তিনি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, আধুনিক টয়লেটে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে তার প্রাসাদের মধ্যে বিরাট এক ফসলি জমি সৃষ্টি করা হয়েছিল। তিনি দেহরক্ষীদের নিয়ে সেখানে যেতেন এবং প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের সময় তার দেহরক্ষীরা গোল হয়ে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতেন আর রাজা মনের আনন্দে আদিম কায়দায় কর্মটি সারতেন।

আমি যে রাজার কথা উল্লেখ করলাম তিনি ছিলেন প্রচণ্ড কামুক ও ধূমপায়ী। তার ডাক্তাররা ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে সজাগ করলে তিনি পাল্টা ধমক লাগাতেন এবং বলতেন, ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ব্যায়াম হয়। তিনি সাধারণত গোসল করতেন না এবং নারী সঙ্গমের পর কোনো দিনই পাক পবিত্র হতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ওই বিশেষ কর্মের পর গোসল না করলে দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়। তার মাথায় কে বা কারা এই দুষ্টবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিলো যে ১৪ বছরের কুমারী মেয়েদের সঙ্গ লাভ করলে তার দীর্ঘায়ু নিশ্চিত। এরপর সেই রাজা কুমারী সম্ভোগের এক অদ্ভুত রীতি চালু করলেন তার রাজ্যে। তার সাথে রাত যাপনকারী কুমারীকে তিনি সার্টিফিকেট দিতেন যা কালক্রমে সেই রাজ্যে বিশেষ সম্মান মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। আমি যার কথা বলছি তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৩ সালে আর মরেছিলেন ১৯৭৬ সালে। তার রাজত্বকাল ছিল ১৯৪৯ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। তার দেশের লোকেরা তার লাশটি এখনো মমি হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছে। গোলাম মাওলা রনি সাবেক সংসদ সদস্য।দৈনিক নয়াদিগন্তর সৌজন্যে

শেয়ার করুন