নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সংখ্যা কেন বাড়ছে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৫০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সংখ্যা কেন বাড়ছে

এম এস সিদ্দিকী : নিউ ইয়র্কভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’-এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধিতে নাইজেরিয়া ও মিশরের পরে তৃতীয় অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ ৩০০ কোটি টাকার (৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের অতি-উচ্চ সম্পত্শালী বা অতি ধনী হিসেবে বিবেচনা করে। বর্তমানে ধনী বৃদ্ধির তালিকায় ভিয়েতনাম, পোল্যান্ড, চীন, কেনিয়া, ভারত, ফিলিপাইন ও ইউক্রেনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সমানুপাতিকভাবে বাড়েনি। কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে যে, ‘গিনি কোএফিসিয়েন্ট’ অনুসারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য ০ থেকে ১ স্কেলে ২০২৩ সালে ০.৫০ হয়ে গেছে, যেটা ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছরে ০.৪৬ থেকে মাত্র ০.৪৮ এর কাছাকাছি পৌঁছায়। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, দেশে বিগত ৫০ বছরে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ ধনীদের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ অংশ ধারণ করে, যেখানে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ ধারণ করে মাত্র ১.৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চিত্র ।

‘ফোর্বস ম্যাগাজিন’ থেকে প্রকাশিত ২০২২ সালের বিশ্ব বিলিয়নিয়ার তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে ২ হাজার ৬৬৯ জন বিলিয়নিয়ার রয়েছে এবং তাদের কেউই বাংলাদেশের নয়। মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো বিলিয়নিয়ার নেই। যদিও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণে অর্থনীতির আকার এবং বিলিয়নিয়ার সংখ্যার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে বিলিয়নিয়ার আছে কিন্তু তারা অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং রিয়েল এস্টেটে তাদের সমস্ত সম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন। এটা বলা যুক্তিযুক্ত কারণ, প্যান্ডোরা পেপারসে ১১ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করা হয়েছিল, যারা ট্যাক্স হ্যাভেন-খ্যাত বিভিন্ন দেশে তাদের সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে দেশের বাইরে পাচারকৃত টাকার সঠিক পরিমাণ অনুমান করা কঠিন। তার ওপর বাংলাদেশে অনেক ধনী ব্যক্তি কর ফাঁকি দেন। এজন্য অনেক ব্যক্তির প্রকৃত সম্পদ অনুমান করা যায় না। মূলত এই কারণেই বাংলাদেশি ধনকুবেরদের নাম বৈশ্বিক তালিকায় আসছে না।

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থীরা হলফনামায় তাদের সম্পদ ঘোষণা করেছেন। জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রার্থীদের সম্পদের ঘোষণায় দেখা গেছে অনেক সংসদ সদস্য কোনো বৈধ পেশা ছাড়াই কোটিপতি হয়েছেন। বাংলাদেশে অনেক কোটিপতি আছে। কোভিড-১৯ মহামারি, বৈশ্বিক মন্দা এবং দেশে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অসুবিধা সত্ত্বেও কোটিপতির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২৩ সালের জুনের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ১ কোটি টাকার বেশি হিসাবধারীর (আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা) সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮৯ জন। তবে এটা একটা নথিভুক্ত সংখ্যা মাত্র, এর বাইরেও অনেক কোটিপতি রয়েছেন। তাদের সম্পদের কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, ব্যাংক খাতে মোট কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৯ হাজার ১৬৩ জন।

গত তিন বছরে মহামারি-লকডাউন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দার ফলে অনেক মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে। বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা পরিচালিত বেশ কয়েকটা জরিপে দেখা যায়—বাংলাদেশে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; যদিও দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ভিন্ন। ‘ক্রেডিট সুইস’ থেকে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ওয়েলথ ডেটাবুক ২০২২’ অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৫০০ কোটি টাকার (৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অধিকারী ছিল ২১ হাজার ৩৯৯ জন। ডেটাবুকটা আরো দেখিয়েছে, কোভিড মহামারি থাকা সত্ত্বেও ২০২১ সালে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার (১-৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অধিকারী বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৯৩১ জন। দেশে কোটিপতির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করতে পারছে না কর বিভাগ। বাংলাদেশের কর থেকে জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যক্ষ করব্যবস্থার প্রগতি খুবই ধীরগতিসম্পন্ন। আবার কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪৫-৬৫ শতাংশ থেকে কোনো কর পাওয়া যায় না।

কালোটাকার মালিকরা এ দেশে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের অর্থ দেশে রাখা নিরাপদ বোধ করেন না এবং খুব সহজেই অন্য দেশে অর্থপাচার করে দেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উত্স ছিল এবং বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু শহর বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা এসব জায়গায় ভিলা, ফ্ল্যাট, ছোট হোটেল, পাঁচ তারকা হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সি-৪-এডিএস)-এর রেকর্ডের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি বলেছে, ৪৫৯ জন বাংলাদেশি তাদের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনেছেন। উক্ত রেকর্ড অনুযায়ী ২০২০ সাল পর্যন্ত তারা সেখানে ৯৭২টি সম্পত্তি কিনেছেন, যার মূল্য প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমতুল্য।

অনেকেই নিজের নামে বা তাদের কাছের ও প্রিয়জনের নামে এসব সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। তারা এই উদ্দেশ্যে তাদের বাংলাদেশী নাগরিকত্বের পরিবর্তে আলবেনিয়া, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকত্ব ব্যবহার করেন। অনেক বাংলাদেশি এমনকি পাম জুমেইরা, সিলিকন ওসিস, অ্যামিরেটস হিল, দুবাই মেরিনা এবং বিজনেস বে-এর দামি এলাকায় বাড়ি ও তারকা হোটেল কিনেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন ধনী ব্যক্তি এসব এলাকায় বিনিয়োগ করে থাকেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং কানাডার বেগমপাড়া বাংলাদেশিদের দ্বারা ক্রয়কৃত সম্পত্তির জন্য বেশ পরিচিত। যদিও বাংলাদেশের আইন বাংলাদেশি নাগরিকদের অন্যান্য দেশে এমন সম্পত্তি ক্রয়ের অনুমতি দেয় না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের একটি সমীক্ষা অনুসারে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। ব্যবসার পরিবেশ বাণিজ্য স্বাধীনতা, আর্থিক স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, করের বোঝা ইত্যাদি পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপ করা হয়। অর্থনীতির আকার, মাথাপিছু আয়, বিনিয়োগের পরিবেশ, বাণিজ্যের উন্মুক্ততা, বেসরকারিকরণের হার, প্রতিযোগিতার নীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, একচেটিয়া বা অলিগোপলিস্টিক প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিসের বাজার সম্পদ আহরণকে সহজ করে তুলতে পারে। এই ফ্যাক্টরগুলোর প্রভাব দেশ-কালপাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে এই ফ্যাক্টরগুলো অনুপস্থিত, তার পরও অতি ধনীর সংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ধনী জনসংখ্যার বৃদ্ধি ডিজিপি বা ইক্যুইটি মার্কেটের উন্নতির সঙ্গে সমানুপাতিক নয়।

ব্যবসায়ীদের জন্য ধনী হওয়া সহজ। শিল্প হিসেবে পরিষেবা খাত শীর্ষ পাঁচ শিল্পের মধ্যে রয়েছে। হাই নেট ওয়ার্থ (এইচএনডব্লিউ) ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই প্রাথমিক শিল্প হিসাবে ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ রয়েছে। উত্পাদন ও প্রযুক্তি শীর্ষস্থানীয় ‘এইচএনডব্লিউ’ শিল্পের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ‘এইচএনডব্লিউ’ জনসংখ্যার জন্য অন্য দুটো শিল্প হলো নির্মাণ এবং প্রকৌশল। অনেক দেশে তেল, এয়ারলাইনস, রেলওয়ে, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মতো প্রাকৃতিক একচেটিয়া মালিকানার বেসরকারিকরণ গুটিকয়েক লোকের পাহাড়সম সম্পদ গড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, রেলওয়ে, এয়ারলাইনস এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মতো সরকারি পরিষেবাগুলো সাধারণত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। তাই এসব অমূল্য সম্পদ মজুত করে বেসরকারি খাতের ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সম্পত্শালী হওয়ার সুযোগ নেই।

উত্পাদনে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবসায় করাও ধনী হওয়ার অন্যতম একটা মাধ্যম। আমরা নিম্ন প্রযুক্তি, মাঝারি এবং উচ্চ প্রযুক্তির রপ্তানিকে (উত্পাদিত পণ্য রপ্তানির পার্সেন্টেজ) একটা সূচক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশের উত্পাদিত রপ্তানির মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ মাঝারি ও উচ্চ প্রযুক্তির রপ্তানি এবং বেশির ভাগই রপ্তানি করে শ্রমসাধ্য ‘আরএমজি সেক্টর’। লেবানন, কাজাখস্তান, মিশর, ইউক্রেন এমনকি ভিয়েতনামে উত্পাদিত রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ প্রযুক্তিগত পণ্য। বাজার পরিস্থিতি ও অর্থনীতির প্রকৃতির মধ্যে অমিল দেশের অতি ধনীদের অস্তিত্বের ব্যাপারে একধরনের চিত্র প্রকাশ করে। কিন্তু কর-জিডিপি অনুপাত, করদাতার সংখ্যা, বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের বিলাসবহুল জীবন এবং দেশ থেকে প্রচুর অর্থপাচার অন্য ধরনের চিত্র প্রকাশ করে। এম এস সিদ্দিকী বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা। দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে

শেয়ার করুন