নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তরুণরা তাহলে যাবে কোথায়

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৪০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৪১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
তরুণরা তাহলে যাবে কোথায়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স’ সার্ভে নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বাংলাদেশের ৪২ শতাংশ তরুণ এখন বিদেশে পাড়ি দিতে চায়। সংখ্যাটি কম শোনাচ্ছে, নাকি বেশি? নির্ভর করছে কাদের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছিল তার ওপর। হতে পারে শহর ও গ্রাম; দু’দিকের তরুণদেরই খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। কেবল যদি শহরের তরুণদেরই জিজ্ঞাসা করা হতো এবং তারা যদি হতো শিক্ষিত তাহলে ৪২ নয়, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক তরুণই বলত, তারা বিদেশে পাড়ি দিতে উন্মুখ। কারণ কী? প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশে কাজ নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। বেকারত্ব অবশ্য গ্রামেই অধিক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শহরের তুলনায় দ্বিগুণ। কিন্তু গ্রামের মানুষের সেই সাহস ও সামর্থ্য কোথায় যে বিদেশে যাবে?

তবু যায়। জমিজমা বেচে, ঘরবাড়ি বন্ধক রেখেও যেতে চায়। কারণ বিদেশে উপার্জনের সুযোগ আছে, দেশে যা নেই। এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে, বিদেশে যারা গেছে তাদের কেউ কেউ আবার ফেরত চলে আসছে। কারণ বিদেশেও এখন কাজের অভাব ঘটেছে। তার বড় কারণ অর্থনৈতিক মন্দা; আরেক কারণ যন্ত্রের উন্নয়নে কায়িক শ্রমের চাহিদাতে ঘাটতি। তা ছাড়া প্রতারকরাও তৎপর। তারাও তাদের কাজ করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যায়। যায় মেয়েরাও। মেয়েদের চাহিদা আছে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরবে। সেখানে গিয়ে অনেক মেয়ে ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে; কেউ কেউ বিক্রি হয়ে যায়। জোর করে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে– এমন অভিযোগও শোনা গেছে। দাসপ্রথা বিলীন হয়ে গেছে, কে বলবে?

বাংলাদেশের তরুণরা এক সময় যুদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অল্পদিন ধরে নয়, অনেক দিন ধরেই। ব্রিটিশ শাসনামলে, পাকিস্তানের কালে। দারুণ যুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। তরুণ ভয় পায়নি। পালিয়ে বেড়ায়নি। দলে দলে যুদ্ধে গেছে। প্রাণপণে লড়েছে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাধ্য করেছে আত্মসমর্পণে। সেই তরুণরাই তো এখন দেখা যাচ্ছে দেশ ছাড়তে পারলে বাঁচে। ওই যে বললাম, বেকারত্ব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কর্মের সংস্থান নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, গত তিন মাসে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ৪ লাখ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর খবরেই প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বেকার এখন ৮ লাখ। সরকারি তথ্য সব সময় সঠিক হয় না; নানা ভুলভ্রান্তি থাকে। বেসরকারি এবং প্রকৃত তথ্য বলবে, বেকারের সংখ্যা আরও অধিক– এমনটাই আমাদের ধারণা। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে, বাংলাদেশের এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন বিদেশে আছে।

দেশের ভেতরে কর্মের সংস্থান বৃদ্ধি পেল না কেন? পরিশ্রম করার মতো লোকের তো অভাব নেই। যে তরুণরা বিদেশে যেতে চায় তারা তো সবাই পরিশ্রম করবে বলেই যায়। এমনকি বিদেশে গিয়ে যারা পড়াশোনার জন্য যেতে সংকল্পবদ্ধ, তারাও তো পরিশ্রম করতে হবে জেনেই যায় এবং গিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে। না; অভাব শ্রমের নয়; অভাব পুঁজির। কিন্তু পুঁজি কেন গড়ে উঠছে না; আয় কেন পুঁজিতে পরিণত হচ্ছে না? না-হওয়ার কারণ আয় বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধনীরা টাকা বিদেশে নিয়ে গিয়ে কেউ কেউ ভোগবিলাস করে, কেউ কেনে বাড়িঘর, অন্যরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি ধনীদের বিপুল বিনিয়োগ গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত কিছু পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তা থেকে আয়ও হয়। কিন্তু রপ্তানি আয়ের ৯ মিলিয়ন ডলার দেশে আসেনি। আয় দেশে আসছে না; বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। আর সাম্প্রতিক সময়েই দুবাইতে বাংলাদেশিরা নাকি যাকে বলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির হার ভারতীয়দেরও হার মানিয়েছে। দুবাইয়ের বণিক সমিতিতে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন এক হাজার ৪৪। [সমকাল, ২৮ অক্টোবর]

তা ব্যবসা করছেন ভালো কথা, কিন্তু এই টাকা তারা পেলেন কোথায়? নিশ্চয়ই দুবাইতে উপার্জন করেননি। নিয়ে গেছেন বাংলাদেশ থেকেই। বৈধ পথে নেওয়ার উপায় নেই, নিষেধ রয়েছে। নিয়েছেন অবৈধ পথেই। বৈধ পথে অনেক ঝামেলা, পদে পদে সন্তুষ্টকরণের আবশ্যকতা; অবৈধ পথ সে তুলনায় মসৃণ, দু’চারটি বিন্দুতে সন্তোষজনক উৎপাদন বাড়লেই চলে, সব দরজা খুলে যায়। পি কে হালদারের অর্থ পাচারের খবরটা অবিশ্বাস্য ঠেকে; যেন ঐন্দ্রজালিক। কিন্তু সেটা ঘটেছে। পি কে হালদার একজন নয়, আরও অনেকজন তৎপর। তা ছাড়া হালদার মহাশয়ের পেছনে ও সামনে নিশ্চয়ই বড়মাপের মানুষেরা ছিল। নইলে তিনি পালালেন কী করে এবং ধরা পড়লেও তাঁর পুরো গল্পটা কেন জানা যাচ্ছে না?


তরুণরা একদা যেভাবে লড়েছিল, এখন তাদের সেই ভাবটা নেই কেন? আমরা জানি, সেই লড়াইটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র তখন মিত্র ছিল না, শত্রু ছিল; লড়াইটা তাই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র কি এখন মিত্র হয়ে গেছে, তাই যুদ্ধের আর দরকার নেই?

না; ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। রাষ্ট্র তখন শত্রু ছিল, এখনও শত্রুই রয়ে গেছে; মানুষের সঙ্গে তার শত্রুতা মোটেই কমেনি; বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই শত্রুতা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সুচতুর ও সুদক্ষ। তদুপরি তার গায়ে আছে স্বদেশের আচ্ছাদন। শত্রুতা এখন ভান করে এবং প্রচার করে যে, তার কাজ জনগণের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও সুখ বৃদ্ধি করা, দেশের উন্নতি ঘটানো এবং রাষ্ট্র করে দেয় এই সংবাদ– রাষ্ট্রের যারা কর্তা তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো বিরোধ নেই। তারা একই দেশের, একই জাতির মানুষ; সবাই সবার একান্ত আপনজন। প্রচারমাধ্যমের শক্তি সবসময়েই অদম্য। প্রযুক্তির বিকাশ ও মালিকানার পুঁজিবাদী দখলদারিত্বে মিডিয়া এখন যতটা শক্তিশালী ততটা আগে কখনও ছিল না। অর্ধসত্যকে তো বটেই, জলজ্যান্ত মিথ্যাকেও সে সত্য বলে প্রতিপন্ন করার ক্ষমতা রাখে এবং ওই কাজই সে করে চলেছে।

মিডিয়া কখনও নিরপেক্ষ নয়। সবসময়ই ক্ষমতাবানদের পক্ষে। তাই দেখি ইউক্রেনে রুশ হামলায় দু’জন মানুষ মারা গেলে মস্ত বড় খবর হয়, কিন্তু ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে গাজার হাসপাতালে যখন এক লহমায় ৫০০ মানুষ প্রাণ হারায়, যার অধিকাংশই শিশু ও নারী, তখন তা দাঁড়ায় একটা সংখ্যামাত্র। মার্কিন গণমাধ্যমের উদ্দেশে লেখা ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি বুদ্ধিজীবীদের একটি ‘খোলা চিঠি’তে যে প্রশ্নটা করা হয়েছে তা সহস্র সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, বিশ্ববিবেক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব যদি এখন সত্যি সত্যি থাকত তাহলে। ‘খোলা চিঠি’তে প্রশ্নটা এই রকম: ‘কেন আমরা সাংবাদিকতার জায়গা থেকে চাপ প্রয়োগ করছি না, কেনইবা আমরা গাজায় যুদ্ধাপরাধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বানোয়াট ছবিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলছি না?’

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, মনুষ্যবেশধারী জানোয়ার বটে। মন্ত্রীর কথাটা এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে, যেন ওটি কোনো ইতর প্রাণীর আওয়াজ নয়, বীরের উক্তি।


বড় রাজনৈতিক দলগুলোই সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ। এটা অবশ্য নতুন কোনো তথ্য নয়, সবারই জানা। তবে বাস্তবিক ও মূল সত্য হলো এই, দুর্নীতির উৎস এদেশের সাম্রাজ্যবাদনির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। নির্বাচন নিজেই ফটকা পুঁজির ব্যবসা। বড় দুই দল-জোটের রাঘববোয়ালরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন, ক্ষমতায় গেলে যা হাজার গুণ হয়ে ফিরে আসে। এ কারণেই ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে এত সংঘাত, হানাহানি। জনগণের ভোটাধিকার পরিণত হয়েছে তামাশায়। দুর্নীতির উচ্ছেদ তাই সংস্কারের ভেতর দিয়ে সম্ভব নয়, প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থার অবসান।

আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের নেতৃত্বে হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ফলে জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত। সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বিরা তাদের অনুগত বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছে। কারণ সমঝোতা হলে এদেশের গ্যাস, কয়লাসহ প্রাকৃতিক ও সমুদ্রসম্পদ কবজা করা সহজসাধ্য হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রয়েছে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। রয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সস্তা শ্রমশক্তি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে

শেয়ার করুন