নিউইয়র্ক     সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা একজনসহ ‘র‍্যাবের ৯ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিল ইইউ’

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:৩৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:৩৩ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা একজনসহ ‘র‍্যাবের ৯ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিল ইইউ’

চলতি বছরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ৯ জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) অন্তত দুটি দেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সরঞ্জাম গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা। মাত্র এক দিন আগেই আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যম জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে সাইবার সিকিউরিটি ও নজরদারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে র‍্যাব।

মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে গত বছরের ডিসেম্বরে গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি আইনের অধীনে র‍্যাবের সাত সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সাত সদস্যের একজনসহ ৯ জন র‍্যাব সদস্য এ বছর নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সেবা গ্রহণ করেছেন। আজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আল-জাজিরা।

আরো পড়ুন।গোলাপবাগ মাঠে গণসমাবেশের অনুমতি পেল বিএনপি

২০১০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো র‍্যাবের বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ করে আসছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘র‍্যাবের মাধ্যমে এই সরকার যে অপকর্মগুলো করেছে, সে ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন। র‍্যাব সম্পর্কে যে নথিগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা এটাই ইঙ্গিত করে যে র‍্যাব প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করছে।’

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র যখন র‍্যাবের শীর্ষ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন তারা প্রমাণ দিয়েছিল যে, র‍্যাব ২০০৯ সাল থেকে অন্তত ৬০০ ব্যক্তিকে জোরপূর্বক গুম করেছে। এ ছাড়া ২০১৮ সাল থেকে কমপক্ষে ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল র‍্যাব।

বিদেশি গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ : আল-জাজিরা জানিয়েছে, তাদের হাতে এমন কিছু নথি এসেছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে যে এ বছরের মার্চ মাসে র‍্যাবের সদস্যরা গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ নিতে পোল্যান্ডে গিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী সদস্যদের মধ্যে র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ রয়েছেন। তিনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত সাত সদস্যের একজন। পোল্যান্ডে র‍্যাব সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইউরোপিয়ান সিকিউরিটি অ্যাকাডেমি (ইএসএ)। এই সংস্থা সাধারণত সামরিক বাহিনীর সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সামরিক সংস্থাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

এ ছাড়া র‍্যাবের ক্যানাইন স্কোয়াডের জন্য ‘পুলিশ ডগস সেন্টার’ থেকে প্রশিক্ষিত কুকুর কেনার জন্য ‘ক্রয়পূর্ব পরিদর্শন’ করতে তিনজন র‍্যাব সদস্য এ বছরের সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডসে গিয়েছিলেন। আল-জাজিরা জানিয়েছে, গত তিন বছরের মধ্যে অন্তত দুবার র‍্যাবের ক্যানাইন স্কোয়াড নেদারল্যান্ডসে এ ধরনের পরিদর্শনের জন্য গিয়েছেন। আল-জাজিরা যে নথি পেয়েছে, তাতে দেখা গেছে, পোল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস সরকারের কাছে র‍্যাব ভ্রমণ বিজ্ঞপ্তির কপি পাঠিয়েছিল।

ম্যাগনিটস্কি আইনে নিষেধাজ্ঞা : মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট’ নামে আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তি ও সংস্থার সম্পদ জব্দ করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওই ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ফার্স্টের আইনজীবী আমান্ডা স্ট্রেয়ার বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কেন সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, তা দেখিয়ে দিয়েছে র‍্যাব কর্মকর্তাদের ইউরোপ ভ্রমণ। তাঁরা যা করতেন (মানবাধিকার লঙ্ঘন) তা আরও ভালোভাবে করার জন্য ইউরোপে প্রশিক্ষণ নিতে গেছেন।’

আমান্ডা স্ট্রেয়ার আরও বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি আইনটি যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডায় প্রায় একই রকম। সুতরাং র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের সবারই রয়েছে।’

তবে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য কঠিন বলেও মন্তব্য করেছেন আমান্ডা স্ট্রেয়ার। তিনি বলেছেন, ‘ইইউ একটি বিশাল বহুপক্ষীয় সংস্থা। ফলে ইইউর পক্ষে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সহজ নয়। আর এ বিষয়টিই সম্ভবত র‍্যাব বুঝতে পেরেছে এবং ইউরোপে প্রশিক্ষণ নিতে গেছে।’

ইউরোপে ২৫ বারেরও বেশি ভ্রমণ র‍্যাবের : আল-জাজিরার তদন্ত ইউনিট (আই-ইউনিট) যেসব নথি সংগ্রহ করেছে, তাতে দেখা গেছে, র‍্যাব কর্মকর্তারা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৫ বারেরও বেশি ইউরোপে ভ্রমণ করেছেন। এসব ভ্রমণের সময় তাঁরা গণনজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং আরও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার জন্য ‘ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শন’ করেছেন।

২০১৭ সালে র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ জার্মানিতে একটি পুলিশের সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন। বর্তমানে তাঁর ওপরেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওই একই সময়ে র‍্যাবের সদস্যরা চীন, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভ্রমণ করেছিলেন।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের লিয়াজো অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্র এই ব্যক্তিদের (র‍্যাব সদস্যদের) প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। প্রকৃতপক্ষে র‍্যাবের প্রতি তাদের (যুক্তরাজ্য ও ইইউ) কঠোর হওয়া উচিত। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল মূল্যবোধ হচ্ছে, কূটনীতির মাধ্যমে উন্নয়ন অংশীদারত্ব, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এসব মূলনীতির বাইরে তাদের যাওয়া উচিত নয়।’

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নেদারল্যান্ডস সদস্য থিজ রিউটেন আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যারা স্পষ্টভাবে জড়িত, তাদের বিষয়ে নেদারল্যান্ডসকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।’ ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘র‍্যাবের দায়মুক্তি অবসানের প্রস্তাবনা’ দিয়েছিল। সেই প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করে থিজ রিউটেন বলেন, ‘আমি এখনো সেই প্রস্তাবনাকে সমর্থন করি এবং বাংলাদেশ সরকারের উচিত হত্যা ও জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে স্বাধীনভাবে তদন্ত করা।’

জবাবের অধিকার : এক প্রশ্নের জবাবে আল-জাজিরার আই-ইউনিটকে ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘তারা র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে অবগত। এমনকি তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও অবগত। কিন্তু ইইউ র‍্যাবের ওপর ওই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আর নেদারল্যান্ডস সরকার কুকুর বিক্রির সঙ্গে জড়িত নয়।’

ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা করে বলেছে, ‘বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কুকুরগুলোকে কৌশলগত পণ্য (সামরিক পণ্য বা দ্বৈত ব্যবহার) হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই এ ধরনের কেনাবেচার জন্য কোনো রপ্তানি অনুমতির প্রয়োজন হয় না। সুতরাং বাংলাদেশে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর রপ্তানির সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িত নয়।’

ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, আগের বছরগুলোতেও র‍্যাব সদস্যরা স্বাধীনভাবে নেদারল্যান্ডস ভ্রমণ করেছেন। এ ধরনের ভ্রমণের ক্ষেত্রে দূতাবাস বা ডাচ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশে ভিসা দেয় না। এই পরিষেবা একটি ভিন্ন সেনজেন দেশের মাধ্যমে হয়েছে।

এদিকে পুলিশ ডগস সেন্টার আল-জাজিরাকে বলেছে, ‘এ বছরের সেপ্টেম্বরে আমাদের কাছে র‍্যাবের কোনো সদস্য আসেননি। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই।’ আল-জাজিরা আরও জানিয়েছে, পোল্যান্ড সরকার, ইউরোপিয়ান সিকিউরিটি অ্যাকাডেমি (ইএসএ) এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

শেয়ার করুন