নিউইয়র্ক     সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দ্রাবিড় সৈকত

নববর্ষের চিত্রভাবনা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
নববর্ষের চিত্রভাবনা

দুই নারী, কামরুল হাসান সংগ্রহ: দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন

বাংলা বর্ষবরণ সামনে এলে আমরা বাংলার দিকে নতুন করে দৃষ্টি ফেরানোর কথা ভাবি। বর্ষবরণকে উপলক্ষ করে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বাংলার প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-দর্শন সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা পাহাড় পরিমাণ। সামগ্রিক বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে তাই বহুধাবিভক্ত আমাদের পণ্ডিতমহল। এর কারণ ওই কেবল বর্ষবরণ অথবা কোনো জাতীয় দিবসেই আমাদের এসব বিষয়ের কথা মনে পড়ে। এর বাইরে গভীর অনুসন্ধানী গবেষণার কোনো তাগিদ কোথাও দেখা যায় না। ফলে আমরা বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি অনেক কম, যতটুকু জানি তাতেও মতবিরোধের অভাব নেই। কেবলই মতবিরোধ নয়, আরো রয়েছে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের প্রশ্ন। বিশ্ববাজারে এ দেশের ভাষা-সংস্কৃতির কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে কি নেই সেসবও বড় আকারে সামনে চলে আসে। আমার আলোচনার বিষয় আপাতত বাংলার চিত্রকলা। চিত্রকলা প্রসঙ্গে আসতে গিয়েই ওসব প্রসঙ্গের অবতারণা।

বাংলার চিত্রকলা কী? বাংলার চিত্রকলায় কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে কি? বাংলায় কি চিত্রচর্চার কোনো প্রাচীন পরম্পরা আছে? এ দেশে কারা চিত্রচর্চা করেছে? এর আদি অধিবাসীদের কোনো সঠিক পরিচয় আছে কি? বাংলার সীমায় যারা বাস করে তাদের সবার চর্চিত চিত্র কি বাংলার চিত্রকলা? তারা কি বাঙালি? চাকমা? গারো? হাজং? মারমা? সাঁওতাল? আর বাংলার সীমানা কতটুকু? বাংলাদেশ? পশ্চিমবঙ্গ? বৃহৎবঙ্গ নামক আরো বড় কোনো সীমানাজুড়ে বাংলা? বাংলা বলতে আমরা কি ১৯৭১ সালের পরবর্তী বাংলাদেশ বুঝব? যদি প্রাচীনকাল থেকে বুঝতে চাই সেটি কত প্রাচীন? পাল? গুপ্ত? মৌর্য? নন্দ? নাকি আরো আগে? সীমানা, সময়, অধিবাসী, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি অনেক বিষয়ের যথাযথ উত্তর ছাড়া বাংলার চিত্রকলা সম্পর্কে আলোকপাত করা কি সম্ভব? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর ছাড়া আমরা বাংলার চিত্রকলা সম্পর্কে যা জানব তার অধিকাংশই বিভ্রমে আকীর্ণ থাকার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

বাংলার চিত্রকলা সম্পর্কে উত্থাপিত বিভ্রমের সম্ভাবনাগুলোর বাস্তব প্রমাণ হলো আমাদের কোনো জীবিত বা মৃত শিল্পী বাংলার চিত্রকলা সম্পর্কে যথাযথ উত্তর দেয়ার বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান থেকে যাচ্ছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে ছবি আঁকার পরামর্শ দিয়েছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পরামর্শে এঁকেছেন কৃষ্ণলীলা সিরিজ। পার্সীয়, মোগল, পাল, লোকজ, রাজপুত, পাহাড়ি, চায়না, জাপানি ইত্যাদি বারোয়ারি বিষয় ধার করে তিনি বঙ্গীয় ধারা তৈরির প্রয়াস নিয়েছিলেন, যা নব্য বঙ্গীয় ধারা নামে সুপরিচিত। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসব পছন্দ করলেন না। তিনি নিজে যখন আঁকা শুরু করলেন তখন দেখা গেল তিনি হাঁটছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। কলকাতা আর্ট কলেজে যেখান থেকে নতুন করে ঔপনিবেশিক ধারা শুরু হলো, সেখানেও চলতে থাকল অধ্যক্ষভেদে ব্যবস্থা। যামিনী রায় গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পটুয়া ধারা অনুসরণের প্রয়াস নিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও এ ধারায় প্রাণের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। পাচ্ছিলেন না যে সেটি বোঝা গেছে তার পরবর্তী স্বীকারোক্তিতে।‘[…] দিন যত গেল, পটের ছবি বাংলাদেশে চলিত রইল পটুয়ামহলের নিছক অভ্যাস হিসেবে এবং শিল্পীরা হয়ে রইল অজ্ঞানের অধম’ (যামিনী রায় ১৩৬৭: ৮৮)। অর্থাৎ একটা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি চলল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর কলকাতা ছেড়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এসে গড়ে তুললেন শিল্প বিদ্যালয়। সেখানে অনুসৃত হলো কলকাতা আর্ট কলেজের সিলেবাস। তিনি নিজে রপ্ত করে নিলেন ইউরোপীয় ধারা। কিন্তু তিনিও আবার গড়ে তুললেন লোকশিল্প জাদুঘর। অর্থাৎ চিত্রকলা আরো নির্দিষ্ট করে বললে বাংলার চিত্রকলা কেমন হওয়া উচিত অথবা কেমন তার বৈশিষ্ট্য এ বিষয়ে আমাদের শিল্পগুরুরা কোনো পথ দেখাতে পারলেন না।

বাংলার চিত্রকলা বলে তাই কোনো সুস্পষ্ট বিষয় বৈশিষ্ট্য বা শৈলীকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো গবেষক অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বাংলার লোকজ বিভিন্ন নকশা, আলপনা, সরাচিত্র, ঘটচিত্র, পটচিত্র, নকশিকাঁথা ইত্যাদিকে বাংলার চিত্রকলা বলে চিহ্নিত করতে থাকলেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরা তাতে ঠিক ভরসা করতে পারলেন না। দেখা যাচ্ছে শিল্পী সুব্রামানিয়াম লোকচিত্রের সঙ্গে আধুনিক চিত্রকলার সম্মিলনে কিছু একটা আঁকছেন। শিল্পী কামরুল হাসান নিজেকে পটুয়া পরিচয় দেয়ার পরেও কিউবিজমের সঙ্গে লোকজ ফর্মের সংযোগ ছাড়া স্বস্তি বোধ করছেন না। এমন দোদুল্যমানতার কারণ কী? চিত্রকলা তো বিশ্বজনীন একটি ভাষার মতো। এখানে নিজস্বতা বা স্বতন্ত্র শৈলীর পরিচয় কি জরুরি? যদি জরুরি হয় তাহলে তাকে চিহ্নিত করে সেখানে থেকে গেলেই হয়; আর যদি না হয় তাহলে সামনে যা আসে তাকেই গ্রহণ করতে দ্বিধা কোথায়? কিন্তু দেখা গেল এমন দোদুল্যমানতার কোনো ঘাটতি নেই। পুরো শিল্পীমহল দুলছে। কারণ বাংলার চিত্রকলা বিষয়ে নিশ্চিত করে বলার মতো কোনো প্রমাণাদি কিংবা ইতিহাসের কোনো নিরেট দলিল অথবা তাকে খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ আমাদের হাতে নেই।

বাংলার চিত্রকলা তাই একটি অত্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ এলাকা। অধিকাংশ শিল্পী-বোদ্ধা-সমালোচক হয়তো বলবেন লোকচিত্র বা পটচিত্রই বাংলার প্রকৃত চিত্রধারা, এখানে ধোঁয়াশার কিছু নেই। এখানেই প্রশ্ন তৈরি হয়, তাহলে চিত্রকলার ষড়ঙ্গ কাদের জন্য কারা তৈরি করেছিল? সেসবের সঙ্গে কি বাংলার কোনো যোগ আছে? লোকচিত্র নামে যা চলমান আছে সেসব কি নন্দনতাত্ত্বিক (বঙ্গীয়, ভারতীয় অথবা বৈশ্বিক) বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য? উত্তরাধুনিক সময়ে স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয়-পরিচিতির ধরন কেমন হবে? সেখানে কি উঁচু-নিচু, ভালো-মন্দের বিবেচনা নেই? বিশ্ববাসী পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় এ সময়ে কিসের ভিত্তিতে নিজেদের নির্ণয় করে? চিত্রকলা বিষয়ে আমাদের অবস্থান কি সম্মানজনক? লোকচিত্রের স্থবিরতা, অদক্ষতা, অক্ষমতা, স্থূলতা, বিষয়ভাবনার ঘাটতি সৃষ্টিশীলতার কোন শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এমন একটি তথাকথিত শিল্পশৈলী কি কোনো জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হতে পারে? যার সঙ্গে প্রথা-পদ্ধতি, নিয়ম-বিধি, লাবণ্য-ব্যঞ্জনা, প্রজ্ঞা-প্রযুক্তির সম্পর্ক নেই? এটি কি আমাদের চিত্রকলা বিষয়ে অজ্ঞতা নয়? অতীতের কোন ধারার সঙ্গে আমরা নিজেদের সংযুক্ত করছি? বাংলায় চিত্রচর্চার কোনো প্রশিক্ষিত ধারা কি নেই? তাহলে এত এত চিত্র-ভাস্কর্য যেখানে, সেখানে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? ভাস্কর্য আর চিত্রকলার মূলনীতি কি আলাদা? এ অঞ্চলে চিত্রকলার ইতিহাস বলে যাকে আমরা প্রচার করছি তার সঙ্গে প্রকৃত অবস্থার কোনো সাদৃশ্য থাকার সম্ভাবনা নেই। ১৬০৮ সালে তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তার ‘The History of Buddhism in India’ গ্রন্থে প্রাসঙ্গিকভাবে বলেন, এখানে চিত্রকলা ও ভাস্কর্য এতটাই বাস্তবসম্মত যে ছবিকে প্রকৃত বস্তু বলে বিভ্রম তৈরি হতো, ‘In the ancient period, the human artists possessed miraculous power and their artistic creations were astounding. In the Vinaya-vastu etc, it is clearly said that the statues made and pictures drawn by them created the illusion of being the real objects. For about a hundred years after the parinirvana of the Teacher, there were many artists like them.’ [Taranath 1980 (1608): 347]. প্রচলিত বাংলার চিত্রকলা বলে পরিচিত লোকচিত্রের সঙ্গে তারানাথের পর্যবেক্ষণের কোনো মিল নেই। কেননা আমরা এখানে অক্ষমতা, অপরিপক্বতা, অজ্ঞতাকে কোনো অজানা (কিছু জানা) কারণে নিজেদের শিল্প হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরে পুরো জাতিকে বিশ্ববাসীর কাছে হাস্যকর ও করুণা-উপহাসের পাত্র বানিয়ে ক্রমাগত অপমান-অপদস্থ করছি। ৬৪ কলার দেশে চিত্রকলা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পমাধ্যম, বিষ্ণুধর্মোত্তরের বর্ণনা অনুযায়ী চিত্রকলাই এদের মাঝে সর্বোত্তম: ‘Painting is the best of all arts, conducive to dharma, and emancipation. It is very auspicious when placed in a house. As Sumeru is the best of mountains, Garuda, the chief of birds, and a lord of the earth, the most exalted amongst men, so is painting the best of all arts.’ (Kramrisch 1928: 62)। সেই সর্বোত্তম শিল্পের চেহারা বলতে আমরা এখন যাকে সামনে আনছি তাতে আর এমন কথার কোনো মূল্য থাকছে না।

বাংলা নতুন বছরে বাংলার সব বিষয়ই আমাদের নতুন অভিনিবেশের দাবি রাখে। কেননা এ উত্তরাধুনিক সময়ে স্থানীয় পরিচিতির সঙ্গেই আমাদের রুচি-সম্মান-সৌন্দর্য-নন্দনবোধ-আত্মপরিচয় জড়িত। এ পরিচয়ের বাইরে বিশ্বজনীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে শেকড়হীন উন্মূল কোনো বিষয় দাঁড়াতেই পারবে না। নিজেদের পরিচিতি সম্পর্কে তাই অনেক প্রশ্নের জবাব আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। চিত্রকলা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাকে লোকচিত্রের অজ্ঞানতা ও কলুষতায় একেবারে ডুবিয়ে দেয়ার অর্থ নিজেরাই দমবন্ধ পরিস্থিতির শিকার হয়ে হাঁসফাঁস করা। বাংলার চিত্রকলায় নতুন বছরে নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণায় আমাদের উদ্ভ্রান্ত শিল্পী-বোদ্ধা-রসিক সমাজের কাছে তার প্রকৃত রূপে ধরা দেয়ার পরিস্থিতি যদি আমরা তৈরি করতে না পারি তাহলে সেই দায় আমাদেরই বহন করতে হবে। দ্রাবিড় সৈকত শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক; সহযোগী অধ্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বণিকবার্তার সৌজন্যে

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন