নিউইয়র্ক     বুধবার, ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবদুর রহিম হারমাছি

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:২০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:২০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছিল। আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা গেছে। অন্যদিকে রিজার্ভের প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি। বাণিজ্য ঘাটতিও কমছে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি ছাড়া অন্য সব সূচকই এখন ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৫ এপ্রিল বুধবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন (৪৩৮ কোটি ৭০ লাখ) ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল প্রায় তিন গুণ, ১২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি। তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানি ব্যয় কমেছে। এটা ভালো দিক। তবে ডলারসংকট কিন্তু কাটেনি। এখনো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এতে রিজার্ভ কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তাই রিজার্ভ যাতে আর না কমে সেদিকে এখন সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আর সে কারণে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে হবে। রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতা সংস্থার ঋণগুলো যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল। এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশের।

গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমে এলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’ বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য ঘাটতি কমে অর্ধেকে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই আট মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই আট মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, ২২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৪৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই আট মাসে ৫৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। গত বছরের এই আট মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম আট মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ : ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। তবে এবার এই সূচকে উল্লম্ফন নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। ওই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে পাঠিয়েছিলেন। তবে নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ফের বাড়তে শুরু করেছে। নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ডিসেম্বরেও বেড়েছে, ১৭০ কোটি ডলার এসেছে। জানুয়ারিতে এসেছে আরও বেশি ১৯৬ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হওয়ায় কম আসে, ১৫৬ কোটি ডলার। তবে সর্বশেষ মার্চ মাসে উল্লম্ফন হয়েছে, এসেছে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি, ২০১ কোটি ৭৭ লাখ) ডলার। সব মিলিয়ে অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার দেশে এসেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।

সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৮ বিলিয়ন ডলার : তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালান্স) বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল। অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওভারঅল ব্যালান্সে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি : আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি রয়ে গেছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে ১১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল। ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরের ১৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় গত অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর। কিন্তু চলতি অর্থবছরে দাতাদের ঋণ-সহায়তা বেশ কমে গেছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে কমেছে ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সে কারণেই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন মনসুর। নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সুত্র : দৈনিক বাংলা

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন