নিউইয়র্ক     সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সরকারে লীন জবাবদিহিতা ও সংসদের বিরোধী দল

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪ | ১১:২২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৪ | ১১:২৩ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
সরকারে লীন জবাবদিহিতা ও সংসদের বিরোধী দল

হারুন উর রশীদ স্বপন : বাংলাদেশে এখন সংসদে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ নেই। ফলে সরকার চাইলেই ভালো কিছু হবে, না চাইলে হবে না। এবার সংসদে আসন পেয়েছে মাত্র পাঁচটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়াকার্স পার্টি এবং কল্যাণ পার্টি। তাদের মধ্যে জাসদ, ওয়াকার্স পার্টি এবং কল্যাণ পার্টি একটি করে এবং জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। ২২২ আসন পাওয়ায় ২০১৮ সালের তুলনায় এবার আওয়ামী লীগের আসন কমেছে। তারা ওই নির্বাচনে ২৫৭টি আসন পেয়েছিল। জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২২টি। এবার জাতীয় পার্টির আসন অর্ধেক হয়েছে। জাসদ দুটি এবং ওয়াকার্স পার্টি তিনটি আসন পেয়েছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়ে আসন পেয়েছিল ৬টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্ররা মাত্র তিনটি আসনে জয়ী হয়েছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩৫টি আসন কমলেও আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র মিলে মোট আসন ২৮৪টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, “আগের দুটি সংসদেরও প্রায় একই অবস্থা ছিল। ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান অনেক উঁচু। আমরা বিলেতের দিকে তাকালে দেখি, বিরোধী দল যে-কোনো সময় সরকারি দল হতে পারে এইরকম তাদের অবস্থান। সক্রিয় বিরোধী দল সংসদে থাকলে তারা সব সময় সরকারকে নজরদারির মধ্যে রাখতে পারে। সেটা শুধু সংসদে নয়, সংসদীয় কমিটিসহ নানা জায়গায়।”

“এখন সংসদে যখন বিরোধী দল না থাকে, অথবা থাকলেও দুর্বল। সেই ক্ষেত্রে সরকার অসতর্ক হয়ে যেতে পারে। তবে যদি দক্ষ ও সত্যিকার বিরোধীরা সংসদে থাকে, তাহলে তারা সংখ্যায় কম হলেও সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে। কিন্তু জাতীয় পার্টি সেটা কী পারবে?,” প্রশ্ন তার।

“সেপারেশন অব পাওয়ার এবং গণতন্ত্রের অন্যান্য যে সংজ্ঞা সেই তুলনায় বাংলাদেশে এক ইউনিক অবস্থা বিরাজ করছে। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। এখন চারটি মেইন স্ট্রিম পলিটিক্যাল পার্টির আড়াইটি সহযোগিতা করতে অক্ষম। এখন যা আছে তার মধ্যে কাজ করতে হবে, ”এই পরিস্থিতি তুলে ধরেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তার কথা, “দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসনের অভাব আছে। এখন তারা দাবি করবে জনগণ আমাদের আবারো ম্যান্ডেট দিয়েছে। তাহলে ওইসব ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের কোনো সূচনার কোনো প্রয়োজন আছে? এভাবে অনেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করবে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের সংসদ নিয়ে সরকার প্রধান তো বরাবরই উচ্চকন্ঠ যে তারা ম্যান্ডেট পেয়েছে। এবার আবারো ফ্রেশ ম্যান্ডেট পেয়েছেন, তাই আরো উচ্চকন্ঠ হবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।”

২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা তখন নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তখন ব্যাপক সহিংসতা হয়। তখন থেকেই বিএনপির দাবি ছিল নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সরকারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে তাদের সংলাপও হয়। কিন্তু নির্বাচনে তারা মাত্র ছয়টি আসন পায়। তারা তখন ‘রাতের ভোটের’ অভিযোগ করে। ফলে তারা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে জানায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে। সেটা না হওয়ায় তারা নির্বাচন বর্জন এবং হরতাল, অবরোধ অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে না যায় সে ব্যাপারে তারা নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করে। এই নির্বাচনে কমিশন দাবি করেছে ৪১ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। কিন্তু বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল এবং অনেক বিশ্লেষকের এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে৷

নির্বাচনের আগে গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি ও সমমনাদের ব্যাপক চাপের মুখে ফেলে সরকার। বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঠে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও ২৮ অক্টোবরের পর থেকে কারাগারে আছেন । গত সাড়ে চার মাসে বিএনপির দেড় হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে দণ্ড দিয়েছেন আদালত। এক দিনে ১১৯ জনকে সাজা দেয়ার নজিরও আছে। তাদের প্রধানত ২০১৩-১৪ সালের মামলায় সাজা দেয়া হয়। সাজার মেয়াদ ছয় মাস থেকে আড়াই বছর।

বিএনপির দাবী ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে ২৫ হাজার ৪৩৯ জনেরও বেশি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে ৭৭০ টিরও বেশি। আহত হয়েছেন চার হাজার ২৭৫ জনের বেশি নেতা-র্কর্মী। একজন সাংবাদিকসহ ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই এখন কারাগারে। এবারও তাই বিএনপি ছাড়া সংসদ।

আগের দুটি সংসদ যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থ পাচার রোধ, সুশাসন- এসব ব্যাপারে তেমন কার্যকর ছিলো তা নয়। আর এই সংসদ আগের চেয়ে আরো দুর্বল। ফলে সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রমে যে চেক এন্ড ব্যালেন্সের একটা বিষয় থাকে যেটা সংসদ করে থাকে। সেই জায়গা আরে দুর্বল হলো বলে মনে করেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গেলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, “সংসদের দিক থেকে আর্থিক সংস্কার এবং অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ আছে তা মোকাবেলায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এককভিত্তিক সংসদ এবং এককভিত্তিক যে একটি সরকার গঠন হয়েছে তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু যদি করে, তাহলে করতে পারে। এর বাইরে কোনো সুযোগ দেখছি না।”

তার মতে, “২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশ হবে তখন অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আইএমফের ঋণের শর্ত মেনে ঋণ ও অর্থনেতিক সংস্কারের বিষয় আছে। দুর্নীতি এখন সর্বব্যাপ্ত হয়েছে। আছে মূল্যস্ফীতিসহ রিজার্ভের চাপ। ব্যয় সাশ্রয়ী হয়ে এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের তেমন উদ্যোগ দেখিনি। সামনে কী হবে তা দেখতে হবে।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামন রীতিমতো অবাক যে প্রক্রিয়ায় সংসদ গঠিত হয়েছে তা দেখে। তিনি বলেন, “যা দৃশ্যমান ছিল তাই হয়েছে। সবই পূর্বনির্ধারিত। এখন তো আর পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নাই। পুরো সংসদে চার-পাঁচজন ছাড়া পুরোটাই হলো সরকারদলীয়। যারা স্বতন্ত্র তারাও সরকারের। জাতীয় পার্টির যারা আছে, তারা আসলে ক্যাঙ্গারু পার্টির সদস্য সরকারের। ফলে পুরো সংসদ হচ্ছে সরকারি দলের একচ্ছত্র ভুবন।”

তিনি বলেন, “গত দুইটি সংসদের অবস্থাও একই রকম ছিল। ফলে এই প্রক্রিয়ায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এটাকে একটা স্বাভাবিকতার রূপ দেয়া হয়েছে। এক সময় বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের ক্রাইসিসে সংসদ জিম্মি হয়ে পড়েছিল। দুই দলই যখন বিরোধী দলে ছিল তখন সংসদ বর্জন করেছে। সেটা থেকে আমরা আরো বড় সংকটে পড়ে গেলাম। দশম এবং একাদশ সংসদ ছিল বাস্তবে বিরোধী দলবিহীন। আর এবার হলো একচ্ছত্র ভুবন। এই অবস্থায় একটি সত্যিকারের জবাবদিহিমূলক সরকার, জনগণের বাস্তব প্রতিনিধিত্বিমূলক সরকার এবং মানুষের অধিকার, সুরক্ষা থেকে শুরু করে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি – এই বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা, জনকল্যাণমূলক বিতর্ক, সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য সংসদীয় কমিটিসহ আরো যে ব্যবস্থা সেগুলো আছে তা যে কার্যকর হবে তার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না।”

তার কথা, “এই সরকার গণতন্ত্রের যে ধারণা, মানুষের অধিকার, মতামত ও জবাবদিহিতার যে ধারণা তার প্রতি তারা কতটা শ্রদ্ধাশীল থাকবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। এই একচ্ছত্র ব্যবস্থায় যদি বেনোভেলেন্ট একচ্ছত্র অবস্থা পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল জবাবদিহিতার কিছু সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে এটা বাস্তবে হওয়া কঠিন।”- জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে-র সৌজন্যে

শেয়ার করুন