নিউইয়র্ক     সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে অর্থ-অনর্থের নির্বাচন

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ | ০২:৩৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ | ০২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে অর্থ-অনর্থের নির্বাচন

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যেন জমেও জমছে না৷ রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় রাজধানী ঢাকার আসনগুলোতে ভোটের আমেজ-উৎসব-উত্তেজনা একেবারেই নেই৷ সরকারি দল আওয়ামী লীগের বাইরে এই আসনগুলোতে শক্তিশালী কোনো প্রার্থী নেই৷ সরকারি দলের প্রার্থীরা জয়ী হবেন—এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়৷ আর তাই ভোটের হাওয়ায় ঢাকায় এবার টাকা কম উড়ছে বলেই মনে হচ্ছে৷ তবে ঢাকার বাইরে ‘টাকার খেলা’ বেশ ভালোই চলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷

অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অর্থ ব্যয়ের বড় অংশ হয় প্রার্থীদের প্রচারে৷ এর বাইরে ভোট টানতে গোপনে ভোটারদের নগদ টাকা দেওয়ার সংস্কৃতিও আছে বাংলাদেশে৷ তবে এবার ঢাকার প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় কিছু টাকা খরচ হলেও ভোট কিনতে ‘নগদ টাকার খেলা’ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না; কেননা, সরকারি দলের প্রার্থীরা নিশ্চিত যে, তারাই বিজয়ী হবেন, তাই তারা অযথা বাড়তি টাকা খরচ করছেন না৷

তবে, সারা দেশের অবস্থা মোটেই ঢাকার মতো নয়৷ অনেক নির্বাচনি এলাকায় টাকা উড়ছে; প্রচার-প্রচারণার খরচের বাইরে নগদ টাকা উড়ানোর প্রতিযোগিতার খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ আর এ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, সরকারি দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে৷ ঢাকার বাইরে অধিকাংশ সংসদীয় আসনে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের খবর প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে৷ অবাধ-নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৩০০ সংসদীয় আসনের ১০০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হতে পারে বলেও খবর দিচ্ছে কিছু মিডিয়া৷ আর এই ঝড়ে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কপাল পুড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷

একটি আসনের কথা না বললেই নয়৷ সব আসনকে ছাড়িয়ে এই আসনটি এবারের ভোটের হাটে সারা দেশের মানুষের নজর কেড়েছে৷ এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে, এই আসনের নির্বাচনের জমজমাট নির্বাচনের খবর৷ আসনটি হচ্ছে হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারঘাট)৷ এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন৷ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন৷ সুপ্রিম কোর্টের আলোচিত আইনজীবী ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সুমন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷

সুমন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে মনোনয়ন চেয়েছিলেন৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয় না দিয়ে প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীকে মনোনয়ন দেয়৷ পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন ব্যারিস্টার সুমন৷ এখন পর্যন্ত বাতাসে যে খবর ভাসছে, তাতে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে কাঁদিয়ে বিপুল ভোটে নাকি ব্যারিস্টার সুমন বিজয়ী হবেন৷ প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর মতো আরও কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে যেতে পারেন বলে একাধিক গণমাধ্যম খবর আসছে৷

এখানে একটি বিষয়ের আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছি৷ তা হলো, এবারের ভোটে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর কোনো আওয়াজ নেই৷ আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্য যিনি প্রার্থী হয়েছেন তিনি এবার ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী নন; ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী৷ এমনটা আগে কখনই কোনো জাতীয় নির্বাচনে দেখা যায়নি৷ এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে বিপুল সংখ্যায় আওয়ামী লীগের নেতা ‘বিদ্রোহী’ নয় ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে দলও সায় দিয়েছে৷

কারণ, বিএনপি ভোটে আসেনি; ক্ষমতাসীনেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখাতে চাইছেন৷ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কেউ জিততে না পারেন, এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছে দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে৷ এর সঙ্গে রয়েছে ভোটারের বেশি উপস্থিতির প্রত্যাশা৷ আওয়ামী লীগের লক্ষ্য নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলা, ভোট উৎসবমুখর করা ও কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো৷ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে তাইতো ভোটের মাঠে এবার আওয়ামী লীগ নিজ দলের নেতাদের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার সুযোগ করে দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে৷ আর তাই তো ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ‘ঈগল’ প্রতীক এবারের নির্বাচনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে৷ কেননা, ব্যারিস্টার সুমনের মতো আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এবার ‘ঈগল’ প্রতীক নিয়ে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন৷ আর এই যুদ্ধে ১০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হলেও অবাক হবে না কেউ৷

১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮: চার নির্বাচন
এবার একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকর হয়৷ এর অধীনে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের ১১টিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারটি আসনে প্রার্থী হন এবং দুটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷ বাকি ২৮৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮২ আসনে জয়ী হয়৷

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশে শুরু হয় কালো অধ্যায়৷ বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন৷ ২০ আগস্ট তিনি ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা (রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট) দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন৷ তিনি ২৪ আগস্ট কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেন৷

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়টা ছিল ব্যাপক ঘটনাবহুল৷ এ সময় সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাসী কর্মকর্তাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন৷ বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও ৭ নভেম্বরের পর জিয়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন৷ ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন৷

জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বছরের ৩০ মে গণভোট হয়৷ জিয়ার ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না, সেটা জানাই ছিল এর উদ্দেশ্য৷ গণভোটে তিনি প্রায় ৯৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বলে সরকারিভাবে দেখানো হয়৷ পরে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই নির্বাচনে জিয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি হন৷ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নেতৃত্বে আসেন৷

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘জয়ী’ হয়ে জিয়া জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ এ নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল৷ এর এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল মালেক উকিল৷ আরেক অংশের নেতৃত্ব দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী৷ নবগঠিত বিএনপি, আওয়ামী লীগের দুই অংশ, ন্যাপ (মোজাফফর), সিপিবি, জাসদসহ মোট ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়৷ সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়ী হয় বিএনপি৷ আওয়ামী লীগ (মালেক) পায় ৩৯টি আসন৷ আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাসদ ৮টি এবং এমএল–আইডিএল (মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ) পায় ২০টি আসন৷ এ ছাড়া স্বতন্ত্র্র প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ১৬টি আসন৷

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনাবিদ্রোহে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন৷ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার৷ ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়৷ এতে এম এ জি ওসমানী ও ড. কামাল হোসেনের মতো প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিজয়ী হন৷ ২৭ নভেম্বর তিনি ৪২ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল ও অনৈক্য তীব্র হয়ে ওঠে৷

এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানে সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন৷ দেশে সামরিক আইন জারি হয়৷ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন৷ এ সময় মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধান স্থগিত করা হয়৷ ২৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয়৷ ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণে পদত্যাগ করলে এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন৷

১৯৮৫ সালের ১ মার্চ এরশাদ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন৷ শীর্ষস্থানীয় অনেক বিরোধী নেতাকে আটক করা হয়৷ সামরিক আইনের কড়া বিধি-নিষেধের মধ্যেই মার্চ মাসে জিয়ার মতো এরশাদও গণভোটের আয়োজন করেন৷ এতে তার পক্ষে ৯৪ ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়৷

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন৷ এরপর তিনি তৃতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করেন৷ বারবার পরিবর্তনের পর ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়৷ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ১৫ দলীয় জোটের কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে৷

ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয়ী হয়৷ ৭৬টি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদের বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়৷ নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ তাদের হেরে যাওয়া ১০০ আসনে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলে৷ ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট এরশাদ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন এবং সেপ্টেম্বরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন৷ ১৫ অক্টোবর আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন৷ এরপর ১১ নভেম্বর সংসদে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বিল পাস হয়৷ এর মাধ্যমে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেয়া হয়৷

১৯৮৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ এরশাদের ক্ষমতা দখলকে আইনি বৈধতা দিলেও তার রাজনৈতিক বৈধতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ৷ কেননা, বেশির ভাগ বিরোধী দল তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে মেনে নেয়নি৷ তারা তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন৷

১৯৮৭ সালের শেষ দিকে আন্দোলন তীব্র হয়৷ একপর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় বেশির ভাগ সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন৷ এমন পরিস্থিতিতে এরশাদ ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ৭ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন৷

দেশে নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার পরও ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ আবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়৷ এ রকম ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায় ওই নির্বাচন নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না৷ জাতীয় পার্টি ও এরশাদের ‘অনুগত’ ছোটখাটো কিছু দল সেই নির্বাচনে অংশ নেয়৷

১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে বড় জয়ের পরেও এরশাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যায়৷ এর পরিণতিতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার পতন হয়৷ শেষ হয় এরশাদের সামরিক শাসনের অধ্যায়৷

১৯৯১ থেকে ২০০৮ পাঁচ নির্বাচন
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের’ সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এরপর থেকে বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল নিয়ে পরাজিত পক্ষ সবসময় নাখোশ ছিল৷

বড় দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয়েছে, তখন তারা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি৷ ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ওই নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি৷ তবে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় কোনো দল সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে৷ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৮৪টি আসনে৷ এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামি ১৮টি আসনে জয়লাভ করে৷ জামায়াতে ইসলামি বিএনপিকে সমর্থন দেয়৷ ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া৷

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার এক বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করে৷ দেশের সবকটি বড় রাজনৈতিক দল সে নির্বাচন বয়কট করেছিল৷ দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য নানা কূটনীতিকের আলোচনা ও মধ্যস্থতার চেষ্টা বিফলে যায়৷ বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলন ও বয়কটের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷

আসন সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে জোরালো লড়াই হয়েছিল ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে৷ সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬টি আসন এবং বিএনপি পেয়েছিল ১১৬টি আসন৷ এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩২টি এবং জামায়াতে ইসলামী তিনটি আসনে জয়লাভ করেছিল৷ সরকার গঠন করার জন্য কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷ এর মাধ্যমে ২১ বছর পরে ক্ষমতার মঞ্চে ফিরে আসে দলটি৷

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল অধ্যায়৷ বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ হয়ে এই নির্বাচনে অংশ নেয়৷ ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করে সংবিধান অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার৷ তখন প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হন তৎকালীন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান৷

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ ওই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে৷ পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশে সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন৷ সে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর যাবত একটানা ক্ষমতায় রয়েছে৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশ নেয়নি৷ এর পর সবশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর৷

১৯৭৩ থেকে ২০২৩ সাল—পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় নির্বাচনে নানা ঘটনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে৷ দৃশ্যমান অনেক বিবর্তনও চোখে পড়েছে৷ নারীর সংরক্ষিত আসন সংখ্যা যেমন বেড়েছে; তেমনি সরাসরি ভোটে অংশ নিয়ে অনেক নারী সংসদ সদস্য হয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর বাইরে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও হয়েছেন অনেকে৷ চোখের সামনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফিরে আসাও দেখেছে দেশবাসী৷

তবে এই নির্বাচনগুলোতে ‘টাকার খেলা’ চোখে পড়েছে সবচেয়ে বেশি৷ বাংলাদেশে শুরুর দিকে বিনা খবচে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হওয়ার নজিরও আছে৷ সে সময় সব দলের ত্যাগী-জনপ্রিয় নেতারা নির্বাচন করতেন; জয়ী হয়ে জনগণের কথা বলতেন৷ এমনও দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ চাঁদা তুলে প্রার্থীর নির্বাচনি খরচ মিটিয়েছেন৷ সেই নির্বাচন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত; সবার অংশগ্রহণে উৎসবমুখর নির্বাচন৷ অনেকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ‘দেশপ্রেমিক’ প্রার্থীর নির্বাচনি খরচ যোগাতেন—যেন তিনি নির্বাচিত হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন৷

কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই৷ প্রার্থী যেমন নির্বাচনটাকে ‘ব্যবসা’ হিসেবে নেন, তেমনি যিনি প্রার্থীর জন্য খরচ করেন তিনিও টাকা খরচ করেন ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে৷ সংসদ সদস্য হলে অঢেল টাকার মালিক হয়ে রাতারাতি ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া যাবে—এই আশায় নির্বাচনে দাঁড়ান৷ আর যিনি প্রার্থী বা নেতার জন্য নিজের পকেট থেকে খরচ করেন—এই আশায় যেনো ১০ টাকা খরচ করে ১০ হাজার টাকার কাজ বাগিড়য়ে নেওয়া যায়৷

আর তার সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামায়৷ যে সব সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের সম্পদ কয়েক গুণ বাড়ার খবর এখন প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে৷ বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান জাতীয় সংসদে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ সংসদ সদস্য হলেন বড় ব্যবসায়ী৷ বড় বড় শিল্প গ্রুপের কর্ণধারেরা এখন ব্যবসার পাশপাশি ভোটেও প্রার্থী হন, জয়ী হন, মন্ত্রী হন…! দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছেন সরাসরি সরকারি দল হোক আর স্বতন্ত্র হোক—একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কোটিপতি নন৷

তাহলে কী আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার পথে হাটছি? আমেরিকায় যেমন ‘বিলিয়নিয়ার্স ক্লাব’-এর সদস্য ছাড়া নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যায় না, বাংলাদেশেও কী তেমনটি হতে চলেছে? একটা বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আলোকপাত করে লেখাটি শেষ করতে চাই৷ বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা কত খরচ করতে পারবেন, তার একটি সীমা বেঁধে দেয় নির্বাচন কমিশন৷ আগের মতো এবারও ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় বেঁধে দিয়েছেন ১০ টাকা৷ তবে ভোটার যতই হোক না কেন, একটি সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারবেন না৷

আমার প্রশ্ন দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে একজন প্রার্থীর জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা কি সম্ভব? যদি হয়…তাহলে খুবই ভালো৷ আর যদি না নয়, তাহলে এই ‘ঘোড়ার ডিমের’ খরচের লাগাম বেধে দেওয়ার কোনো মানে আছে কি?-আবদুর রহিম হারমাছি, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন