নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্থনীতি-২০২২

সংকট সারাবছর

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
সংকট সারাবছর

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা হলেও কমতে থাকে চলতি বছরের শুরু থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা আশার আলো দেখা দিলেও ক্রমশ তা হারিয়ে যেতে থাকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট দেখা দিতে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হয় ব্যাপকহারে।

বৈদেশিক লেনদেনের খরার কারণে অনেকটাই চাপে পড়েছে দেশের আর্থিক খাত। পুরো বছরই নিস্তেজ ছিল পুঁজিবাজার। বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত- তবে তা নেতিবাচক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য। নানা সংকটের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নতুন বছরের সংকট।

বছর জুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল এবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় প্রতিনিয়ত কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। এতে দেশে তীব্র ডলার সংকট দেখা দেয়। সংকটের কারণে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় বন্ধ। এলসি জটিলতায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে শিল্প খাত।

আলোচনায় ব্যাংক খাত: করোনা ভাইরাসের ধকল থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দায়ভার ব্যাংকের ঘাড়ে তুলে দেয় সরকার। ছোট-মাঝারি-বড় শিল্প খাতের জন্য তহবিলের জোগান দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির পুরনো গল্প হার মানে বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের নজিরবিহীন দুর্নীতির কাছে।

বছরের শেষের দিকে আলোচনায় আসে শরীয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনা। গ্রাহকরা জমানো অর্থ তুলে নিতে থাকেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজিরবিহীন হস্তক্ষেপে আলোচনা কিছুটা কমেছে। তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কোনো পক্ষই।

নিস্তেজ পুঁজিবাজার : বছরের প্রথমার্ধে পুঁজিবাজারের ব্যাপক লেনদেন হতে থাকে। কারসাজির মাধ্যমে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে পুরো বাজারে চাঙ্গাভাব দেখা দেয়। কিন্তু বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চাঙ্গাভাব একেবারে চলে যায়। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন এবার ৩০০ কোটি টাকার নিচে নেমে যায়। বাজারের পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়। তবে সর্বনিম্ন দরেও অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই দীর্ঘদিন। বাজারের ক্রেতা ফেরাতে ফ্লোর প্রাইস আংশিক তুলে দেয়া হয়েছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে ধাক্কা ও রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আমদানির আড়ালে পাচার হয় বিপুল অর্থ। এলসিতে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেশি দেখানোর প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দল। ফলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়। যদিও রপ্তানিতে অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় হয়।

কিন্তু অর্থপাচার, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে আমদানি খরচ বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়। চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার; আর দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি দেখা দেয়। চলতি অর্থবছরেও এ ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে।

গত জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে ধাক্কা এসেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও গত বছরের তুলনায় কম পরিমাণে প্রবাসী আয় হওয়ায় অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ সূচকটি হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স আসে ২২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ২০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে কমেছে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। নিয়ম অনুযায়ী এটি বাড়ার কথা।

ডলারের বিপরীতে টাকার দামে ভয়াবহ পতন : বাণিজ্য ঘাটতি ও প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। ফলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকার মান রেকর্ড পরিমাণে কমে যায়। বছরের শুরুতে ৮৫ টাকায় থাকা ডলারের দাম খোলাবাজারে ১২০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের পরও ১১০ টাকার আশপাশে অবস্থান করছে মুদ্রাটির দাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রেকর্ড পরিমাণে কমিয়েছে টাকার মান।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এক বছরের ব্যবধানে দেশীয় মুদ্রার মান কমিয়েছে ১৬ টাকা। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে এক ডলার ১০১ টাকায় বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০২ থেকে ১০৫ টাকায়। রপ্তানি আয় নগদায়ন হচ্ছে ১০৪ টাকায় আর রেমিট্যান্সে এক ডলার বিনিময় হচ্ছে ১০৭ টাকায়।

রিজার্ভ থেকে প্রতিমাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি : ডলারের দামে অস্থিরতা কাটাতে আমদানি এলসিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বিলাসী পণ্যসহ বেশ কিছু পণ্যে শতভাগ মার্জিন নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বাজার স্বাভাবিক রাখতে ও জরুরি পণ্যের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের আগস্টে বিক্রি শুরু হলেও মূলত চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ বাড়তে থাকে।

বছর শেষে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ডলার বিক্রি হয় রিজার্ভ থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়ে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা ডলারের পরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন। বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বিক্রি হয় ৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। পরের মাসগুলোতে ডলার বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে। প্রতিমাসে এক বিলিয়নের বেশি বিক্রি হওয়ায় ডিসেম্বর শেষ না হতেই এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার।

এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ২০ বিলিয়ন ডলার : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বছরের শুরুতে (ডিসেম্বর-২১ শেষে) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর বছর শেষে গত বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর-২২) গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩৪ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) কয়েকটি খাতে বিনিয়োগ ও ঋণ বাবদ দেয়া হয়েছে আরও ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ইডিএফ ফান্ডে সরবরাহ করা হয়েছে সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার

এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলের তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে দেয়া হয়েছে চার কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে (আইটিএফসি) আমানত রাখা হয়েছে রিজার্ভ থেকে। এসব বাদ দিলে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে রেকর্ড ২০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি পণ্যে হাহাকার ও পর্যুদস্ত শিল্প খাত : রিজার্ভ ধরে রাখতে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করে সরকার। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করা হয় উন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়া কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, গাড়ি ক্রয়ে বিধিনিষেধসহ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনা দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে।

তবে আমদানি পণ্যে আরোপিত বিধিনিষেধ সাময়িক স্বস্তির কারণ হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিশাল জটিলতা দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হয় আমদানিনির্ভর ক্ষুদ্রশিল্প ও অনলাইন উদ্যোক্তারা। এলসি সংকট ও বেঁধে দেয়া মার্জিনের কারণে সময়মতো পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসেছেন।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যেই নাজেহাল দশা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। একই সঙ্গে বাজারে কাগজ ও ইলেকট্রনিক পণ্যসহ আমদানি পণ্যে হাহাকার দেখা দেয়। প্রয়োজনীয় পণ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আবার টাকা দিয়েও প্রয়োজনমতো পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন