নিউইয়র্ক     রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রভাবশালী দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকদের ঢাকা সফর : বিএনপির সঙ্গে তারা কেউ কথা বলেননি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:১০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৩৬ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
প্রভাবশালী দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকদের ঢাকা সফর : বিএনপির সঙ্গে তারা কেউ কথা বলেননি

নির্বাচনের বছরে প্রথম দুই মাসেই ঢাকা সফর করেছেন কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা। সরকারি পর্যায় ছাড়াও নানা মহলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে, তাদের কেউই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। এমনকি অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নয়। বিশেষ করে ভারত ও চীনের কূটনীতিকরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায় ছাড়া অন্য কোনো পর্যায়ে কোনো বৈঠক রাখেননি।

তবে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ কূটনীতিকরা এর আগে ঢাকায় এলে সরকারি বিভিন্ন পর্যায় ছাড়াও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু চলতি বছরে যে কয়েকজন কূটনীতিক ঢাকায় এসেছেন তাদের কেউ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, যে কূটনীতিকরা আসছেন তারা যেসব বক্তব্য সরকারের কাছে রাখছেন সেটা বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তারাও মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন, বিএনপিও এ বিষয়গুলো নিয়েই সোচ্চার। এ কারণেই কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের পৃথকভাবে দেখা করার প্রয়োজন পড়ছে না। অন্যদিকে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান মনে করেন, প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপিকে আর গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে না। এ কারণেই তারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন অনুভব করেন না।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সফরগুলোতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে আগামীতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার তাগিদ উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচনে আসার মতো পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে সরকারকে এক ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। যা বিএনপির মনোভাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। যে কারণে ঢাকা সফরকালে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের সাক্ষাৎ না করার বিষয়টি কারও কারও কাছে ঠিক হিসাব না মেলার মতো ব্যাপার বলে গণ্য হচ্ছে।

বছরের শুরুতেই গত ১০ জানুয়ারি আফ্রিকা সফরে যাওয়ার পথে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। ওই স্বল্প সময়ে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতিতে তার আর কোনো কার্যক্রমের সুযোগও ছিল না। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ঢাকায় এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্য-বিষয়ক দূত রুশনারা আলী। তিনি সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেননি। অথচ ২০১৩ ও ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের সময় প্রতিবারই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। কিন্তু বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। একইভাবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে ঢাকা সফরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। এবং তিনিও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।

অথচ ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ঢাকা সফরে এসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২০১৪ সালে তৎকালীন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকায় এসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি ঢাকা সফরে এসে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করেননি। ২০২০ সালের অক্টোবরে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানও ঢাকা সফরে এসে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। সে সময় স্টিফেন বিগানের সাক্ষাৎ চেয়ে না পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাকযুদ্ধ চলে। বিএনপি নেতাদের দাবি ছিল- আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক কমিটি সাক্ষাৎ চেয়েও পায়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দাবি ছিল- তারা স্টিফেন বিগানের সাক্ষাৎ চায়নি, বরং বিএনপি ই-মেইল পাঠিয়ে সাক্ষাৎ চেয়েও পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির ঢাকা সফরের ক্ষেত্রে দুটি পক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মতবিনিময়ের সূচি থাকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি অনুযায়ী কোনো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি পক্ষ বিবেচনা করা হয়। একটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দেশটির সরকার এবং সে দেশের সুশীল সমাজ। মূলত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বা সংগঠনের (এনজিও) সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, মানবাধিকার কর্মী, খ্যতিমান গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সাংবাদিকদেরই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। এর বাইরে বিশেষ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পক্ষের প্রতিনিধির সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন।

দু’দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে, ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোত্রা ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জাং সঙ মিন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তাদের কারো সঙ্গেই বিএনপি নেতাদের কোন সাক্ষাৎ হয়নি।

জানুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় ডোনাল্ড লু’র সঙ্গে বিএনপির কোনো যোগাযোগ হয়েছিল কি না বা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল কি না সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘না, আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এ ধরনের কোনো কর্মসূচিও ছিল না। আপনারা দেখেছেন, এর আগেও যদি এ ধরনের কোনো কর্মসূচি থাকে, সেক্ষেত্রে তারা আগেই আমাদের জানান দিয়েছে, আমরা গেছি। এবার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তারা কোনো যোগাযোগ করেনি।’

গতকাল ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের পকেটে চলে গেছে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যেমন এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, তেমনি বিশ্ববাসী, বিশ্ববিবেক প্রতিবাদ করছে। এই প্রতিবাদ বাংলাদেশে যেমন তীব্র হচ্ছে, বিশ্ববাসীও জোর করে ক্ষমতায় যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।’

পরে অনুষ্ঠান শেষে বিকালে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আসা কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির কোনো বৈঠক হয়েছে কি না বা বৈঠক করার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল কি না? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওরা (বিদেশি কূটনীতিকরা) আসছে সরকারের কাছে। তাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকের আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে- এদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যু। এগুলো আমাদেরও ইস্যু। এসব ইস্যু নিয়ে আমরাও সোচ্চার। আমাদের এসব ইস্যু নিয়ে তারাও এখানে এসে সরকারের সঙ্গে কথা বলছে। তাই আমাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার তো প্রয়োজন দেখি না।

এ ব্যাপারে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক কমিটির আরেক সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, বিদেশি কূটনীতিকরা সরকারি সফরে এসেছেন। তারা সরকারের সঙ্গে বৈঠক করছেন সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে। তাই বিএনপি কেন, দেশের আর কোনো দল, এমনকি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তারা বৈঠক করেননি। তিনি বলেন, বিএনপি যেসব ইস্যু নিয়ে কথা বলছে, বিদেশি কূটনীতিকরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও এসব বিষয় নিয়েই সোচ্চার।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর এ বিষয়ে বলেন, ওরা (বিদেশি কূটনীতিকরা) যখন সফরসূচি সেট করে, তখন সরকারি পর্যায়ে করে। (বিএনপির সঙ্গে) কেন দেখা করছে না এটা তাদের ভাবনার বিষয়। আমি এর ব্যাখ্যাটা বলতে পারব না। তবে মোটামুটি বিএনপি যা বলে সেগুলো কথাই তো তারা বলছেন।

কোনো নিয়মের বিষয় আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না নিয়ম কিছু নাই। এটা একেক দেশের নীতির ওপর নির্ভর করে। তবে এমনটাও তো হতে পারে যে, বিএনপির সঙ্গে দেখা হলে গভর্নমেন্ট নারাজ হতে পারে। এজন্য তারা হয়তো গভর্নমেন্টকে হোস্টাইল করতে চাচ্ছে না।

তবে বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, কূটনীতিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক না করলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির। এ যোগাযোগ মজবুত করার জন্য বেশ কয়েকবার দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক কমিটি ঢেলে সাজানো হয়। তারা বিভিন্ন দেশে সরকারের নানা কাজকর্মের বিরুদ্ধে বক্তব্যসহ চিঠিও দেয়।

চলতি মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, দেশে চলমান দুর্নীতি, অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরে বিএনপির পক্ষ থেকে বহুজনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, বহু দেশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সুত্র প্রতিদিনের বাংলাদেশ

 

শেয়ার করুন