নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দ্বৈত নাগরিকত্ব : বাংলাদেশের ঋণখেলাপিদের জন্য ‘বিশেষ উপহার’!

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩ | ০৬:০৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ | ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দ্বৈত নাগরিকত্ব : বাংলাদেশের ঋণখেলাপিদের জন্য ‘বিশেষ উপহার’!

বাংলাদেশের নাগরিকদের সাধারণভাবে ১০১টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ দিবে সরকার৷ তবে বেশি সুবিধা কি অর্থ পাচারকারী এবং ঋণখেলাপিদের হবে? বিশেষজ্ঞরা তেমন শঙ্কার কথাই বলছেন৷

মন্ত্রিপরিষদ সোমবার নতুন করে আরো ৪৪টি দেশকে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার আওতায় এনেছে। এর আগে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা ছিল। সেগুলোও বহাল রাখা হয়েছে। তাই সব মিলিয়ে এখন ১০১টি দেশের জন্য এই সুবিধা দেয়া হলো। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রেখেই ওইসব দেশের নাগরিকও হওয়া যাবে। তবে এজন্য আবেদন করতে হবে।

নতুন ৪৪টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, লাতিন অ্যামেরিকার ১২টি, ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দেশ রয়েছে

যারা দ্বৈত নাগরিক হতে পারবেন

সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যরা অন্য দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। সরকারি কর্মকর্তারা অন্য দেশের নাগরিকদের বিয়েও করতে পারবেন না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন অনু বিভাগের উপ-সচিব আলীমুন রাজীব জানান, ‘‘বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেয়, তাহলে কোনো কোনো দেশে শপথ নিতে হয়, আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থাকে না। তখন যদি সে আবার আবেদন করে বাংলাদেশ তাকে নাগরিকত্ব দেয়। দ্বৈত নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট দেয়া হয়। সেটা দিয়ে সে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয় পত্র সব কিছুই করতে পরে। অর্থাৎ, সে বাংলাদেশেরও নাগরিক। তখন নাগরিকের সব অধিকার এবং সুবিধা তার প্রাপ্য।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ছাড়া কয়টি দেশের নাগরিকত্ব সে নিতে পারবে সেটা আসলে দেখার বিষয় নয়, তার দরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রাখা। সে সরকার নির্ধারিত এক বা একাধিক দেশের নগরিকত্ব নিতে পারবে।”

সাধারণ নিয়মের বাইরে সরকারি কর্মকর্তাসহ সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা আলাদা আইন আছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে সেই আইনগুলোও দেখা হয় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ” সরকারি চাকরি আইনে সরকারি কর্মকর্তারা দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পান না। সংসদ সদস্যরা সংবিধান ও আরপিও অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিক হতে পারেন না।”

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘‘বিচাপতিদের দ্বৈত নাগরিকত্বে কোনো বাধা নেই। আমি নিজেও দ্বৈত নাগরিক। সাবেক বিচারপতি ঈমান আলীও দ্বৈত নাগরিক। কারণ, সংবিধানে বিচারপতিদের যোগ্যতার ব্যাপারে বলা হয়েছে তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। আর কিছু বলা নেই। অন্যদিকে সংসদ সদস্য হলে তারা অন্য দেশের নাগরিক হতে পারবেন না বা অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে পারবেন না। তাই দ্বৈত নাগরিকরা সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে সেটা ত্যাগ করতে হবে।”

দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা-অসুবিধা

ইমিগ্রেশন আইনজীবী ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন বলেন, ‘‘দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা অনেক। যদি বাংলাদেশের কেউ বিদেশি নাগরিকত্ব নেয়ার পর তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকে, তাহলে বাংলাদেশে তার আর কোনো নাগরিক অধিকার থাকে না। এখানে সম্পত্তির অধিকারই বড়। সম্পত্তি কিনতে পারে না। আবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়। দ্বৈত নাগরিকত্ব হলে দুই দেশেই সে সব নাগরিক অধিকার পায়। দুইটি দেশই তার দেশ। আবার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হয়, তাহলে তাদের বাংলাদেশের অধিকার পেতে সমস্যা হয়। দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান সেটা দূর করেছে।”

তিনি জানান, দ্বৈত নাগরিকত্ব না থাকলে বিয়ে এবং সন্তা’ন দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়।’

অন্যদিকে, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে একজন ব্যক্তি একাধিক দেশের পাসপোর্ট রাখতে পারেন। দুই দেশে আসা-যাওয়ায় কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না বলে জানান তিনি। লন্ডনে বসবাসরত বুলবুল হাসান বাংলাদেশ ও ব্রিটেন দুই দেশেরই নাগরিক। তিনি বলেন, ‘‘দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার কারণে আমার পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকয়্যার্ড’ সিল আছে। এখন বছরে যখন প্রয়োজন আমি দেশে আসতে পারি। সেখানে পরিবারের লোকজন আছে। দুই দেশেই আমার সম্পদের মালিকানা আছে। আমি দুই দেশেরই নাগরিক।’’

যারা বিনিয়োগকারী, তারাও সুবিধা পান। দুই দেশেই তারা নাগরিক হিসেবে বিনিয়োগ করতে পারেন, সম্পদ অর্জন করতে পারেন। বিদেশি হিসেবে এটা করার ক্ষেত্রে অনেক আইনি ঝামেলা হয় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘‘ভারতীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা আছে। এমনকি ঋষি সুনাকের স্ত্রী এখনো ভারতীয় নাগরিক। তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, ‘‘আমি এমনও দেখেছি এখানে কেউ কেউ আছেন তারা চার পাঁচটি দেশের নাগরিক। এই সময়ে একক নাগরিকত্বের বিধান কোনো দেশে থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।” তবে সুপ্রিম কোর্টের আইজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘দ্বৈত নাগরিকত্বের দেশ কোন প্রেক্ষাপটে সরকার বাড়ালো তা নিয়ে ভাববার আছে। কারণ এটা নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলছে।”

তিনি বলেন, ‘‘ক্যানাডার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন এক বাংলাদেশি বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে ব্যবসা করছেন। তিনি বাংলাদেশে আসার পর দুদক তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছেন। আদালত এমিকাস কিউরি হিসেবে এই মামলার শুনানিতে আমাকে ডেকেছিলেন। আমার কথা হলো, এতে সাধারণ নাগরিকদের হয়ত সুবিধা হবে, কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাচারও বেড়ে যাবে।”

তিনি বলেন, ‘‘তারা দেশে ফিরে জমি বিক্রি করবেন, ব্যবসা করবেন, টাকা আরেক দেশে নিয়ে যাবেন। কারণ, তিনি দুই দেশেরই নাগরিক।”

তার মতে, ‘‘ভেবে দেখতে হবে কাদের সুবিধা দেয়ার জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের দেশের সংখ্যা আরো বাড়ানো হলো। অনেকেই দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে বাড়ি-গাড়িসহ অনেক সম্পদ করেছেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধায় তারা হয়ত সেটা হালাল করতে পারবেন।’’ প্রসঙ্গত, সার্কভুক্ত দেশ এবং মিয়ামারের সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা নেই বাংলাদেশি নাগরিকদের।-হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা

শেয়ার করুন