নিউইয়র্ক     সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিন কারণে বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে?

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৫১ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৩ | ০১:৩১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
তিন কারণে বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে?

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের দুই শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেশ ঘনঘন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ‘ঘনঘন’ এর মাত্রা এতোই তীব্র যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা যখন হয়তো এক দেশের নেতাকে বিদায় জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই হয়তো আরেক দেশ থেকে আগত নেতাকে বরণ করতে ছুটতে হচ্ছে! অতি সম্প্রতি এমন ঘটনার নজির আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

চলতি বছরের একেবারে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাখার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এইলিন একই সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টাও বটে। যাই হোক, এইলিন লউবেখার ঢাকায় আসার দিন দশেক পরই ঢাকা সফরে এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। লক্ষণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদ্বয়ের ঢাকা সফরের মাঝখানে (আফ্রিকা যাওয়ার পথে) হঠাৎ করেই বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করে বসেন চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং।

এসবের নেপথ্যে কী? যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন কি এই অঞ্চলে পরাশক্তির মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে? উভয় দেশই কি বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত জোট গঠনে আগ্রহী? দ্য জিওপলিটিক্স এ লেখা এক নিবন্ধে গবেষক অমিত ঠাকুর বলছেন, দুটি প্রশ্নের উত্তরই হলো ‘হ্যা’। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় কৌশলগত সময়ের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলছেন, মূলত তিনটি কারণে সম্প্রতি পরাশক্তি দেশগুলোর শীর্ষ কূটনীতিকদের ঘনঘন বাংলাদেশ সফরের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওই তিনটি কারণ হলোঃ করোনাকালের পর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মার্কিন-চীন দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সাথে কথা বলতে রাজধানী ঢাকার শাহীনবাগের একটি বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়াকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অমিত লিখেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা বাড়ানোর অনুরোধও এসেছে। জোরপূর্বক গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর উপর দেশটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে ঢাকার সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় মার্কিন কূটনীতিকদের নানা মন্তব্যের পর ওই উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের (তৎকালীন) রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ২০২১ সালের মে মাসে দেশটিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটের যেকোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে “যথেষ্টভাবে ক্ষতিগ্রস্ত” করতে পারে।

বাংলাদেশের জবাব ছিল, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করবো। পরে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থানের আশ্বাস দেন।

যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে বাংলাদেশের সাথে তার সাম্প্রতিক উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে চীন দেশটির কাছাকাছি যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন-মিয়ানমার সম্পর্ক মূলত চীনা ফ্যাক্টর দ্বারাই প্রভাবিত ছিল। পশ্চিমারা মিয়ানমারের ওপর অনেক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে, সেগুলো মিয়ানমারকে নিজের দিকে ঝুঁকতে চীনকে সাহায্য করেছিল।

গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি উল্লেখ করে অমিত ঠাকুর লিখেছেন, “ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে বাণিজ্য থেকে বিনিয়োগ, শ্রম অধিকার, নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক সহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বেশ স্পষ্ট ও খোলামেলাভাবে আলোচনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে অপরিহার্য অংশীদার বলে মনে করে। এটি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ যে এশিয়াকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের মূলনীতি প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলে চীনা আধিপত্যকে নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চীনা বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন অংশীদারিত্বে দেশটির সম্পৃক্ততা ত্বরান্বিত হওয়ার প্রেক্ষিতে “অফশোর ব্যালেন্সারের” জন্য বিষয়গুলো অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, দেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখবে। এর কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারাটা ‘চ্যালেঞ্জিং’।

ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যা বলেছেন, বাংলাদেশ তাই করছে- এমন ইঙ্গিত করে অমিত ঠাকুর বলছেন, “বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট: তারা চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়”। তবে কাজটি যে কঠিন সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি লিখেছেন, “উদীয়মান বনাম উদীয়মান” যুদ্ধের এই খেলায় চিরতরের জন্য “খেলার মাঠ” হয়ে ওঠা এড়াতে বাংলাদেশকে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।- মানবজমিন

শেয়ার করুন