নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তালিকায় নেই শীর্ষ ৬ খেলাপির নাম

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
তালিকায় নেই শীর্ষ ৬ খেলাপির নাম

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন, যাদের ১০টিই চট্টগ্রামের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই ১০ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা।

অথচ অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তালিকায় নাম নেই চট্টগ্রামের শীর্ষ ছয়টি ‘পলাতক’ শিল্প গ্রুপের, যাদের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এই ছয়টি শিল্প গ্রুপের মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। ঋণের টাকা পরিশোধ না করে তারা ‘আত্মগোপনে’ আছেন। ঋণখেলাপির দায়ে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। মামলাগুলো এখন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন।

সংসদে অর্থমন্ত্রীর প্রকাশিত তালিকার ১ নম্বরে থাকা সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু তালিকায় নাম না থাকা চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সিএলসির চেয়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ খেলাপি হয়েও তালিকায় নুরজাহান গ্রুপের নাম আসেনি।

একইভাবে তালিকার ২০ নম্বরে থাকা সিদ্দিকী ট্রেডার্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর চট্টগ্রামের জাতীয় পার্টির নেতা মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের ক্রিস্টাল গ্রুপের নামে ১২ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। প্রায় ২৫৯ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি হয়েও ক্রিস্টাল গ্রুপের নাম শীর্ষ ২০-এ তালিকাভুক্ত হয়নি।

তালিকায় ১ থেকে ২০ নম্বরে থাকা ঋণখেলাপির চেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েও চট্টগ্রামের ওই ছয় ‘পলাতক’ শিল্প গ্রুপের নাম না থাকার বিষয়টিকে ‘গোঁজামিলের’ তালিকা বলেছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী।

প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই। তালিকাটি নিশ্চয় একচোখা নীতিতে করা হয়েছে। এমন গোঁজামিলের তালিকা সংসদে প্রকাশ করা অর্থমন্ত্রীর উচিত হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘তালিকার ১ থেকে ২০ নম্বরে উল্লেখিত ঋণের চেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের মামলা চলমান থাকার পরও শীর্ষ তালিকা’য় চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাপলাতক শিল্পমালিকদের নাম থাকবে না কেন? তারা তো হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির দায়ে মামলা চালাচ্ছে। মামলা দায়েরকারী ব্যাংকগুলো নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে এ তথ্য জানানোর কথা। আর অর্থমন্ত্রীও নিশ্চয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হালনাগাদ তথ্য নিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছেন। তাহলে গোঁজামিলটা হলো কোথায়? সেটাই এখন অর্থমন্ত্রীর খুঁজে বের করা উচিত। অর্থমন্ত্রীর উচিত সংসদে সংশোধনী তালিকা প্রকাশ করা।’

সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির যে তালিকা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপন করেছেন, সেই তালিকায় চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানই ১০টি। ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। আর যে ছয় শিল্প গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ শীর্ষ ২০ তালিকায় আসেনি, তাদের ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।

যদি ওই ছয় শিল্প গ্রুপের নাম শীর্ষ ২০-এ তালিকাভুক্ত হতো, তাহলে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানই হতো ১৬টি। অর্থমন্ত্রী যে ছয়টি শিল্প গ্রুপের নাম উল্লেখ করেননি, সেই গ্রুপগুলোর মালিকদের কেউ সরাসরি এবং কেউ পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকায় নাম নেই নুরজাহান গ্রুপের। এই গ্রুপের চার কর্ণধারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রামে অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান।

নতুন করে পরোয়ানাভুক্ত আসামিরা হলেন- মিজানুর রহমান, জহির আহমদ রতন, টিপু সুলতান ও ফরহাদ মনোয়ার। তাদের মধ্যে টিপু সুলতান অন্য মামলায় কারাবন্দি আছেন। বাকি মালিকরা দেশ-বিদেশে পলাতক রয়েছেন।

তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির আহমদ রতন এখন দেশে অবস্থান করছেন বলে অর্থঋণ আদালতকে অবহিত করেছে ব্যাংক। তার পাসপোর্ট জব্দের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক।

এছাড়া নুরজাহান গ্রুপের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলা চলছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জনতা ব্যাংকের দায়ের করা ৩২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা খেলাপি ঋণের দায়ে গ্রুপের কর্ণধারদের পাঁচ মাসের আটকাদেশ দিয়েছিলেন অর্থঋণ আদালত।

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের বনেদি ব্যবসায়ীদের মধ্যে নুরজাহান গ্রুপ ছিল অন্যতম। ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় বড় অঙ্কের লোকসান, ঋণের টাকায় জমি কেনা ও কর্ণধারদের ‘ভোগবিলাসের’ কারণে গ্রুপটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা আটকে যায়। এ পর্যন্ত গ্রুপটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মাররিন ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেড, নুরজাহান সুপার অয়েল লিমিটেড, জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডসহ গ্রুপটির কমপক্ষে ২০টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, নুরজাহান গ্রুপের কর্ণধার জহির আহমদ ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা।

মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমানসহ সাত মালিকের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ঋণখেলাপির মামলায় ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হন চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমান। বর্তমানে জামিনে থাকা হেফাজতুরের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। গ্রুপটির সাত মালিকই এখন পলাতক। অথচ একসময় চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল মোস্তফা গ্রুপ।

মিশম্যাক গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। গ্রুপের পরিচালক তিন ভাই হুমায়ুন করিব, মিজানুর রহমান শাহীন ও মজিবুর রহমান কানাডা ও সিঙ্গাপুরে পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক ছাড়াও ঋণের টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) মামলা করেছে।

ইমাম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা। তিনি পালিয়েছেন আরব আমিরাতে। ইমাম গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে অন্তত ৬০টি। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের দায়ে মোহাম্মদ আলী, আলী ইমাম, মনির আহমেদ, ফেরদৌসী বেগম ও রিজিয়া খাতুনকে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।

ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার তিন ভাই জয়নাল আবেদীন, জামিল আবেদীন ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। তারা তিনজনই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পালিয়ে আছেন। তারা সীতাকুণ্ডে শিপব্রেকিং ব্যবসায় জড়িয়েছিলেন। ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, এফঅ্যান্ডএফ শিপ রিসাইক্লিং, ম্যাক শিপবিল্ডার্স ও প্রিমিয়াম ট্রেড করপোরেশনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তারা।

ক্রিস্টাল গ্রুপের কর্ণধার ও জাতীয় পার্টির নেতা মুরাদ ইব্রাহীমের ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা। তিনিসহ তার সহযোগীরা এখন কানাডায় পালিয়ে আছেন। তারা একসময় চট্টগ্রামের শীর্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ করে সেই টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন তারা।

জনতা ব্যাংকের লালদীঘি শাখায় নুরজাহান, মোস্তফা এবং ইমাম গ্রুপের ঋণ আছে। ওইসব ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক নুরুল মোস্তফা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিনটি গ্রুপের কেউ তাদের ঋণ রিশিডিউল করেনি। মামলাগুলো আদালতে চলমান রয়েছে।’

খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকায় ইমাম গ্রুপের অফিসে গিয়ে পরিচালক পর্যায়ের কাউকে পাওয়া যায়নি। ছোট্ট একটি অফিসে চার-পাঁচজন কর্মচারী ছিলেন। তারা কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বক্তব্যের জন্য মোস্তফা গ্রুপের অফিসে গেলে সেখানেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

শেয়ার করুন