নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডলার অস্থিরতার শেষ কোথায়

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:০৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:০৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ডলার অস্থিরতার শেষ কোথায়

খোলা বাজারে ডলার কেনাবেচা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের বাজারে মার্কিন মুদ্রা ডলার যেন সোনার হরিণ। নগদ ডলার বা অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি সবকিছুর জন্য হাহাকার। আমদানিকারকেরা সামান্য ডলারের জন্যও ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নিজেদের কারখানা ও ব্যবসা সচল রাখতে যে কোনো মূল্যে ডলার কিনতে রাজি অনেকেই। এ জন্যই ডলারের দাম হুহু করে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করছে। কিন্তু এখন নিজেদের র্নির্ধারিত দাম নিজেরাই ভাঙছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে সর্বোচ্চ ব্যয় করতে হবে প্রতি ডলারে ১১০ টাকা। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত এখন নিজেরাই অমান্য করে ১১ থেকে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা পর্যন্ত মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে কেউ কেউ। এখন প্রশ্ন হলো, ১১৮ টাকা মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে কত টাকায় তা বিক্রি করবে।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করা হবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দরে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তও অনেকেই মানতে পারছে না। বেশি দামে ডলার কিনে বেশি মূল্য নেওয়া হচ্ছে। তবে তা সরাসরি না নিয়ে কখনো করপোরেট ডিলিংসের নামে বা কখনো অগ্রিম ডলার বিক্রির নামে বাড়তি প্রিমিয়াম নিয়ে। এভাবে কোনো কোনো আমদানিকারকের কাছ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত ডলারের মূল্য নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো শিথিলতা দেওয়া হয়নি। রেমিট্যান্সের মূল্য তো নির্ধারণ করাই আছে। কিন্তু কেউ যদি বেশি দামে ডলার আনে তাহলে এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা লোকসান দিয়ে কম দামে ডলার বিক্রি করবে। তিনি বলেন, বেশি দামে ডলার বিক্রির জন্য ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। সুতরাং বেশি দামে ডলার বিক্রি যারা করবে তাদেরকে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার শিথিলতা দেখাবে না।

এদিকে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ, অপর দিকে গ্রাহকের চাপ সব মিলিয়েই তারা বিপাকে পড়েছেন। কারণ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা রেমিট্যান্সের ডলারের অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করলেও এ মূল্য কেউই মানছে না।

ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় অবৈধ পথে ডলারের দাম অনেক বেশি। এ জন্য প্রবাসীরা হুন্ডিতে ঝুঁকছেন বলে ধারণা অনেকের। গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে এসেছে গত মাসে। সেপ্টেম্বরে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে এত কম প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। ডলার-সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলার-সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই মতামত দেন যে ডলারের দাম বেঁধে রেখে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়, কারণ বেশি দাম পাওয়ার কারণে প্রবাসীদের অনেকেই আয় হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন। জানা গেছে, প্রবাসী আয় তলানিতে নামার পর ডলার-সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনার পরামর্শ দেয়। ফলে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই দেশে প্রবাসী আয় আসা অনেকটা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনলে সেটা খুবই দুঃখজনক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনানুষ্ঠানিক এমন কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। ডলারের দাম নিয়ে আতঙ্ক থাকলে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে মার্জিন পদ্ধতি চালু করতে পারে। এতে ডলারের হঠাৎ দামবৃদ্ধি রোধ করা যাবে। না হলে দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে, যার প্রভাব পড়বে খাদ্যপণ্যের ওপর। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ডলারের বাজার নিয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সময়মতো দাম বাজারভিত্তিক করা গেলে এই সংকট তৈরি হতো না।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ডলারের এক ধাক্কা দেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। পণ্য আমদানি কমে গেছে, আমদানি হলেও দাম বেশি পড়ছে। শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। টাকার মান কমায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। ডলার বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকলে সামনে আরও খেসারত দিতে হবে।

এদিকে ডলারের আয় ক্রমাগত কমে যাওয়া এবং ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক চাপে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার বা ৪১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর গত ১১ অক্টোবর সেই রিজার্ভ কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি ডলার বা ২৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ আরও কম, ২ হাজার ১০৭ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আর নিট রিজার্ভ ধরলে তা এখন ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের নিচে বলে জানা গেছে। রিজার্ভ বাড়ানোর অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্কলন হচ্ছে আগামী জুন শেষে রিজার্ভ ৩ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ আর বাজারে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়া হয়েছে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি ডলার। ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়িয়েছে, সেটাও বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশের ডলার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অনেকটাই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক ৩টি প্রধান কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা বিঘ্ন হওয়া; পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণের মূল্যবৃদ্ধি। আর আন্তর্জাতিক পরিম-লের এসব ঘটনাপ্রবাহের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ফেড নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি তৈরি হয়। তাতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটে দফায় দফায়।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত নীতিমালা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাজ করছে না। ডলার-সংকট নিয়ন্ত্রণে মূল বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। ডলারের দর বাজারভিত্তিক না করায় এখন হুন্ডি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন