নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোলাম মওলা

ভুল নীতির কারণে বাংলাদেশে ডলার সংকট, কমে গেছে এলসি খোলা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৩ | ০২:২৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২০ মে ২০২৩ | ০২:২৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ভুল নীতির কারণে বাংলাদেশে ডলার সংকট, কমে গেছে এলসি খোলা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে না—এমন আশঙ্কার কথা বলে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে দেশে ডলারের সংকট থেকেই যাচ্ছে। আর ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট থাকার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধ থাকায় কমে যাচ্ছে (লেটার অব ক্রেডিট) এলসি খোলার হার। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যমানের ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে তা আটকেও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার-স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণ কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে এপ্রিলে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এপ্রিল মাসে এলসি খোলা হয়েছে ৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৯ শতাংশ কম। অর্থাৎ বিগত ৩২ মাসের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন। এর চেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে ৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত মার্চে এলসি খোলা হয়েছিল ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের। ফেব্রুয়ারিতে খোলা হয়েছে ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয়, ডলার সংকটের কারণে এপ্রিলে যে পরিমাণ এলসি নিষ্পত্তি যা হয়েছে, তা গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত এপ্রিলে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৪.৬৯ বিলিয়নের। ২০২১ সালের জুলাই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪.৬৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-এপ্রিল (২০২২-২৩) সময়ে শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে ৩১.৮৫ শতাংশ। এর ফলে শিল্প স্থাপনে নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগও কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৬.৯১ শতাংশ। এর প্রভাবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

এদিকে গত এপ্রিলে প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি রফতানি আয়েও বড় ধাক্কা লেগেছে। অর্থাৎ ডলার সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান দুটি উৎস থেকেই দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। সাধারণত ঈদের মাসে প্রবাসী আয় অন্য সময়ের তুলনায় বেশি আসে। কিন্তু এবার ঈদের মাস এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। আবার এপ্রিলে পণ্য রফতানি কমে হয় ৩৯৬ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। ফলে ডলার সংকট ধীরে ধীরে বাড়ছে।

ডলার সংকট নিরসনে এই মুহূর্তে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারের হাতে ছেড়ে না দেওয়ার কারণে ডলারের সংকট বাড়ছে। আর ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা কমে যাচ্ছে। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর সার্বিক প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের হাতে ছেড়ে না দেওয়ায় মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ তো হয়নি, বরং উল্টো সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন না। রফতানি আয়ও কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়— ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ও সুদ বাবদ বেশি টাকা চলে যাবে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতেই পারছেন না। এতে করে নতুন করে ঋণ নিতে পারছে না। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে সময় মতো এলসি নিষ্পত্তি করতে না পারার কারণে দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে।’

জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এলসি কম খোলার কারণে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের আমদানি কম হলে দেশের উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে। কারণ, ইমপোর্ট ডিউটি, ট্যাক্স, ভ্যাট থেকে সরকারের আয় কমে যায়। সেই সঙ্গে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। সবকিছু মিলে মূল্যস্ফীতি চড়া হয়।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, এলসি মার্জিন রাখাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শর্ত মানার পরও ব্যাংকগুলো চাহিদা মতো এলসি খুলছে না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে এলসি খোলার জন্য। এতে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এলসি খুলতে না পারলে পণ্যের সংকট দেখা দেয়। আর পণ্য সংকট দেখা দিলে পণ্যের দাম বাড়ে। এতে মানুষের কষ্ট বাড়ে। তবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় যদি এলসির পেমেন্ট না দেওয়া হয়। অর্থাৎ এলসি নিষ্পত্তি করতে না পারটা দেশের জন্য বড় ব্যর্থতা।’ তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে যত কম এলসি খোলা যায়। এটা রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা। তবে ইন্টার-ব্যাংকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এলসি খোলা কমেছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত জুলাই- এপ্রিল সময়ে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ২৪৪ কোটি ডলারের। গত বছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৫৬৮ কোটি ডলারের। ফলে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র খোলার পাশাপাশি ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার কমেছে ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রের পাশাপাশি শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে এই সময়ে। গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৯২ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৮১ কোটি ডলার। অর্থাৎ কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩১.৮৫ শতাংশ। একইভাবে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘একদিকে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলছে না। অপরদিকে রফতানি পরিস্থিতিও ভালো নেই। এছাড়া গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। ফলে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটোরই আমদানি কমে গেছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। আর এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৬৩২ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে ৬৫২ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে ৬৫৪ কোটি ডলারে ওঠে। অর্থাৎ জুলাই থেকে আগস্ট-প্রতিমাসে গড়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৬০০ কোটি ডলারের বেশি করে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে এসেছে। প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখতে দুই বছর ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিলে) ৫৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৬২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

অবশ্য রোজার মাসে ভোজ্যতেল, চিনিসহ আরও কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলা বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর দুই মাস আগেও জানুয়ারি, ডিসেম্বর ও নভেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ আরও কমিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, ডিসেম্বরে ৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার এবং নভেম্বরে ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ক্রমাগত কমছে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ। মার্চ থেকে এপ্রিলে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এপ্রিলে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, মার্চে ৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন, ফেব্রুয়ারিতে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন এবং জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এপ্রিলে ৫৭ শতাংশ কমেছে টেক্সটাইল ও লেদার মেশিনারিজের মতো ক্যাপিটাল মেশিনারিজের এলসি খোলার পরিমাণ। কম্পিউটার বা মোটরসাইকেলের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারির এলসি খোলা কমেছে ৪৬ শতাংশ। টেক্সটাইল ফেব্রিক ও কেমিক্যালের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের এলসি খোলা কমেছে ৩২ শতাংশ। সিমেন্ট, স্ক্র্যাপ ভেসেলের মতো ইন্টারমিডিয়েট পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশ, চাল ও গমের মতো ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ। সুত্র ওয়েব পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন

সাথী/পরিচয়

শেয়ার করুন