নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দারিদ্র্য বিমোচনে চীনা কৌশলে বাংলাদেশের আগ্রহ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ০১:১৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ০১:১৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দারিদ্র্য বিমোচনে চীনা কৌশলে বাংলাদেশের আগ্রহ

বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় পরাশক্তি চীন। প্রায় একযুগের সংস্কার কার্যক্রমে ; দেশটির মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে ঈর্ষণীয়। দারিদ্র্য বিমোচনেও চীন এখন বিশ্বের উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী করার পাশাপাশি হাতে নেয়া হয় গ্রামীণ পুনরুদ্ধার প্রকল্প। বলা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে চীনা ধারণা গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশ।

উৎপাদনশীলতায় বিশ্বে শীর্ষ দেশের তালিকায় আছে চীন। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে প্রযুক্তি এবং যন্ত্রাংশ উৎপাদন। এতে বিশ্বের মধ্যে বাড়ছে চীন নির্ভরতা। আর উৎপাদনশীলতা নীতি গ্রহণের ফলে সবাই পাচ্ছে কাজের সুযোগ। এতে চরম দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে বিশ্বের বৃহৎ এই দেশ। শত কোটির বেশি মানুষের দেশের সব মানুষদের কাজের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে নীতির পরিবর্তন করেছে চীন।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য চীন ৯০ দশকের শেষ দিকে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নেয়। পাঁচ বছর পরপর তারা সেটা যাচাই-বাছাই করে। এতে ধাপে ধাপে সুফল আসে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘চীন শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চরম দারিদ্র্য থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছে। তারা শিক্ষা পদ্ধতি, দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করেছে। আমাদের দেশে নারীদের শ্রমবাজারে আনার জন্য পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২’ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

গেল ১০ বছরে চীন দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্জন করেছে। এ সময়ে চরম দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। মোট ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হবার তথ্য দিয়েছে দেশটির সরকার। অর্থাৎ জাতিসংঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার চেয়ে ১০ বছর আগে চীন তার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করেছে। এ সময়ে চীনের মাথাপিছু জিডিপি ৬৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ১২৪৭১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে বেড়েছে মানুষের জীবনযাপনের মানও।

গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে শহুরে বাসিন্দাদের তুলনায় গ্রামীণ বাসিন্দাদের নিষ্পত্তিযোগ্য আয় আরও দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। আগামী ১৫ বছরে চীনে মাঝারি আয়ের গ্রুপের লোকসংখ্যা ৮০ কোটি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

১০ বছর ধরে চীনের অর্থনীতির বৃদ্ধির গড় গতি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। জিডিপি ৫৩ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান। মার্কিন ডলারে এটি ১৮ ট্রিলিয়ন। ফলে অর্থনীতিতে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের হিস্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের অবদান ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং টানা ৬ বছর ধরে চীন বিশ্বের বৃহত্তম পণ্য বাণিজ্যে দেশ হয়ে আসছে। চীন বর্তমানে ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন রপ্তানি আয় করে রপ্তানির শীর্ষ দেশের অবস্থানে রয়েছে। সেই সঙ্গে টানা ১৪ বছর ধরে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি বাজারের অবস্থান ধরে রেখেছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চীনে গবেষকদের সংখ্যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। দেশটি সবসময় মৌলিক গবেষণা ও নবায়নে জোর দিচ্ছে। চীনের গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় ২০১২ সালের ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৩ দশমিক ০৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ান হয়েছে।

চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়ার পর সংস্থার স্বাধীনতা ও বহুপক্ষবাদের নীতি রক্ষা করেছে এবং অন্য সদস্য দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চলতি বছর হচ্ছে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ প্রস্তাবের ১০ম বার্ষিকী। এক অঞ্চল এক পথ প্রস্তাবের আওতায় গেল ১০ বছরে চীন বিশ্বের ১৫১টি দেশ, ১৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ২০০টির বেশি সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ডাব্লিউটিওতে যোগ দেয়ার পর উন্মুক্তকরণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে ২০১৩ সালে চীন এক অঞ্চল, এক পথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। মুক্ত ও ন্যায্য বাণিজ্য জোরদারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চীনের অবদান সবচেয়ে বেশি। চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং ভূরাজনীতির শক্তিশালী দেশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন অব্যাহতভাবে অন্যান্য দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) মহাসচিব আল মামুন মৃধা দৈনিক বাংলাকে বলেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য, সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে উৎপাদনশীলতা পর্যায়ে পৌঁছাতে চীন তাদের শিক্ষাগত কাঠামাতে পরিবর্তন আনে। কারিগরী শিক্ষায় যেন মানুষ বেশি মনোযোগ দেয়, প্রত্যেক ঘরে যেন শিল্প-সংশ্লিষ্ট মানুষ থাকে এবং সেগুলোকে বিপণনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পুরো দেশকে উৎপাদশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করেছে। এটা দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, চীন তাদের ই-কমার্সকে ব্যাপক উন্নত করেছে। সবাইকে বাধ্য করেছে ক্যাশলেস সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত হতে। এতে করে গ্রামীণ পর‌্যায়ে উৎপাদিত পণ্যও সরাসরি গ্রাহক হাতে পাচ্ছেন। তারা একদিকে গ্রামীণ লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করেছে ই-কমার্সে অংশগ্রহণে, অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগী যারা আছেন তারা ছাড়া সরাসরি গ্রাহক পণ্য পেয়ে যাচ্ছেন। গবেষণায় চায়না এখন বিশ্বে প্রথম। বিভিন্ন খাতে নিজস্ব ইনোভেশন তারা সততা ও সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছে। এটা চায়নার উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

আল মামুন মৃধা আরও বলেন, চীন সরকার দুর্নীতির ‍বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেটা তাদের নীতি উন্নতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ব্যবসা করতে হলে নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। জননিরাপত্তায় ২৪ ঘণ্টা মানুষের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করেছে। এসব কারণে ৩০ বছরের মধ্যে চায়না নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বলা হচ্ছে, চীনের উন্নয়ন মডেল ধরে নীতি সাজালে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য পেতে পারে বাংলাদেশ।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘চায়না বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তাদের অর্থনীতিকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করেছে। আমাদের দেশেও এসব নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। দারিদ্র বিমোচনে আমাদের দেশেও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কারণ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে চরম দারিদ্র্যমুক্ত করতে হবে। চীন সরকার শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষেরও উন্নতি করেছে। তারা অভ্যন্তরীণ বাজার বড় করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এভাবে তারা নিজেদের প্রসারিত করেছে। -মৌসুমী ইসলাম, দৈনিক বাংলা

শেয়ার করুন