নিউইয়র্ক     রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গমের ব্লাস্ট রুখতে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার হবে বৈশ্বিকভাবে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
গমের ব্লাস্ট রুখতে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার হবে বৈশ্বিকভাবে

শাহাদাত বিপ্লব: বাংলাদেশে ধানের পরই প্রধান খাদ্যশস্য গম। বর্তমানে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি গমের তৈরি। বাঙালিদের মধ্যে রুটি-পরোটা খাওয়ার চলও বেড়েছে আগের চেয়ে। তাই গত এক দশকে দেশে গমের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে উঠে এসছে। তবে ২০১৬ সালে দেশে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ায় ওই বছর গম উৎপাদন কমে যায় প্রায় ৩৩ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশেও ছত্রাকজনিত রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মহামারী আকার ধারণ করার আগেই তা চিহ্নিত করতে ২০২০ সালে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একদল গবেষক। প্রযুক্তিটি এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র (সিআইএমএমওয়াইটি)।

জানা গেছে, গমের ব্লাস্ট ও রাস্ট রোগ নির্ণয়ে আগাম সতর্কীকরণ পদ্ধতির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাজ্যের সংস্থা ফরেন, কমওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এফসিডিও)। ব্লাস্ট রোগ ছাড়াও গমের রাস্ট রোগের আগাম সতর্কীকরণ পদ্ধতিগুলোর উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কাজ করবে দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, সাব সাহারা আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মেক্সিকোর ২৩টি গবেষণা ও একাডেমিক সংস্থা। দেশের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সিআইএমএমওয়াইটির ‘হুইট ডিজিজ আর্লি ওয়ার্নিং অ্যাডভাইজরি সিস্টেম’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্লাস্ট রোগ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি ‘ক্রিপসার-বেজড পয়েন্ট-অব-কেয়ার প্লান্ট ডিজিজ ডায়াগনস্টিকস’-এর মাধ্যমে গমের গাছ বা বীজ পরীক্ষা করে রোগ নিশ্চিত করা যায়। এ প্রযুক্তির সাহায্যে আমদানি-রফতানি করা গমেও ব্লাস্ট রোগ রয়েছে কিনা তা শনাক্ত করতে পারবে সঙ্গনিরোধ উইং। তাই সিআইএমএমওয়াইটি তাদের প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি ব্যবহারবান্ধব ও স্বল্প খরচে সরবরাহের জন্য গবেষণা চালাবে। সেই সঙ্গে এটির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বিভিন্ন দেশের কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের। এর পরই বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিটি সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হবে।

ব্লাস্ট চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেয়া ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (আইবিজিই) অধ্যাপক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ব্লাস্ট রোগ গমের জন্য ভয়াবহ একটি রোগ। তাই আমরা ২০২০ সালে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি, যা সহজেই ছত্রাকজনিত রোগটিকে শনাক্ত করতে পারে। পরবর্তী সময়ে কয়েক ধাপে প্রযুক্তিটি নিয়ে গবেষণা হয়। সর্বশেষ বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে সিমিটের সমন্বয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের প্রযুক্তি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও রাস্ট রোগ শনাক্তকরণ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করা হবে। এ প্রকল্পে আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিকে বড় অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তিও হয়েছে। এতে কৃষক এসব রোগের ক্ষেত্রে আগাম সতর্ক হতে পারবেন, যাতে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। প্রকল্পটির এটি বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হবে।’

প্রযুক্তিটির ব্যবহার সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘দেশে আমরা কৃষকের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করেছি। তবে বাণিজ্যিকভাবে এখনো ব্যবহার শুরু হয়নি। ২০২১ সালে ওএমসি হেলথকেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল এর কিট উৎপাদনে। এ প্রযুক্তি অনেকটা মানুষের গর্ভধারণ পরীক্ষার মতো। গমের কোনো একটি অংশ গুঁড়ো করে স্ট্রিপের দ্রবণে রাখলে ব্লাস্টের উপস্থিতি আছে কিনা তা খুব সহজে জানা যাবে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল দেবে। শুরুতে এ কিট উৎপাদনে প্রায় ৭০০ টাকা খরচ হলেও এখন ৩০০ টাকার মতো লাগবে।’

বিশ্বব্যাপী গমের ব্লাস্ট রোগকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনুকূল আবহাওয়া পেলে এ রোগ শতভাগ গম নষ্ট করে ফেলে। ব্লাস্ট গমের শীষের ভেতরে দানা তৈরি হতে দেয় না। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে গমে প্রথম এ রোগ দেখা দেয়। ওই বছর চারটি জেলার ১৫ হাজার হেক্টর জমির গম নষ্ট হয়ে যায়। রোগটির আক্রমণের পর দেশে গম উৎপাদন ১২ লাখ থেকে আট লাখ টনে নেমে আসে। ২০১৮ সালে রোগটি আফ্রিকার জাম্বিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এটি বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ঝুঁকি হিসেবে মনে করছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাস্ট ও ব্লাস্ট রোগ গমের জন্য ভয়ংকর। কৃষক যদি এ রোগগুলোর ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা পেতে পারেন তাহলে অনেক বড় ক্ষতি থেকে ফসল রক্ষা করা সম্ভব। কারণ আগেই জানা গেলে তা ছত্রাকনাশকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ কারণে প্রযুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ হবে।’

শেয়ার করুন