নিউইয়র্ক     শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত জীবন

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:২০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:২০ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত জীবন

রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। আগস্টে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশীয় পয়েন্ট। এটি এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আলু, চাল, পেঁয়াজ, মরিচ, ডিমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং প্রাকৃতিকগত কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই মাসে (গত আগস্ট) সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। রোববার ‘কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই)’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এদিকে মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, আলু, ডিমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে। সেই সঙ্গে বন্যা এবং অতিবৃষ্টির কারণে আগস্টে পণ্যের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলোর একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। অল্প কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে তাদের হাতে বন্দি থাকে পণ্যের দাম। এই সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

বিবিএস-এর গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালের একই মাসে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০২০ সালের আগস্টে ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছরের গত ছয় মাসে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় ছিল। গত জুনে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, মে মাসে ৯ দশমিক ২৪, এপ্রিলে ৮ দশমিক ৮৪ এবং মার্চে ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ।

বিবিএস-এর মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতি হিসাব করতে দেশের ১৫৪টি বাজার থেকে ৭২২টি পণ্যের (আইটেমের) তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই বাজার নির্দিষ্ট করা হয় যেখানে মানুষের সংখ্যা বেশি, সেখানে বাজারও নেওয়া হয়েছে বেশি। সেজন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাজারের সংখ্যা বেশি। তবে বাজার ও পণ্য কোনোটিই বিবিএস এককভাবে নির্ধারণ করেনি। আইএমএফ, আইএলও-সহ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে তাদের সঙ্গে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের কোথাও ফুড ও ননফুড আলাদা করে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে না।

আমরা ঐতিহ্যগতভাবে এটা করে আসছি। খাদ্য আলাদা হিসাব করার কারণে প্রধান কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলেই মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তবে সব মিলিয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ঘর পেরিয়ে যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছরও আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। এ সময়টায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংকট এখনো কাটেনি। তবে অনেকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে। কিন্তু এই কমার প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে কিছুটা সময় নেয়। ফলে আগস্টে খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

বিবিএস জানায়, গত আগস্টে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এছাড়া শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বাজারে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেভাবে আমাদের বেতন তো বাড়ছে না। তাহলে আমরা কী করব। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা জুনা মিয়া বলেন, আমি একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করি। বেতন যা পাই, তা দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। নিজের বাসায় থাকি বলে ভাড়া দিতে না হলেও খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দামের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা মো. রাসেল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ৫ জনের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে সঞ্চয় যা ছিল, তা ভেঙে সংসারে জোগান দিয়ে যাচ্ছি। জানি না, আগামী দিনে কী হবে।

কুড়িগ্রামের বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক মির্জা মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, সরকার প্রণোদনা হিসাবে বেতনের সঙ্গে যা দিয়েছে, এতে মাত্র এক হাজার টাকা বেড়েছে মাসিক আয়। কিন্তু অন্যসব পণ্যের দামই বেড়েছে কয়েক গুণ। এ টাকায় দুর্বিষহ দিনযাপন করছি। এদিকে জমিতে চাষাবাদ করতেও সার, তেল, সেচ, দিনমজুরসহ সবদিকেই খরচ বেড়েছে। ফলে জমিতে ফসল চাষ করেও লাভ পাওয়া যাচ্ছে না। সবদিক থেকেই আমাদের মতো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের অবস্থা খুব খারাপ।

সূত্র জানায়, আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এদিকে কয়েক মাস ধরেই দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ওঠানামার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জুলাইয়ে ছিল ৯ দশমিক ৬৯, জুনে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং মে মাসে ব্যাপক বেড়ে হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

এদিকে গত আগস্টে মজুরি হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, জুনে ৭ দশমিক ৩৯ এবং মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। আগস্টে কৃষি খাতে মজুরি বাড়লেও কমেছে শিল্প ও সেবা খাতে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষি খাতে আগস্টে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে, জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কিন্তু শিল্প খাতে আগস্টে মজুরি হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এদিকে সেবা খাতে মজুরি কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে এ হার ছিল ৭ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এর আগে যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বাড়ছে। সেই ব্যয় বৃদ্ধিটা সমস্যা হতো না, যদি একই হারে আয়টা বাড়ত। বাস্তবতা হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, সেই হারে আয় বাড়ছে না। ১৮ মাস ধরে দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এক্ষেত্রে মানুষ টিকে থাকার জন্য সঞ্চয় ভেঙে অথবা ঋণ করে খাচ্ছে। কিন্তু যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, তাদের তো কোনো সঞ্চয় নেই। কিংবা কেউ ধারও দেয় না। এ অবস্থায় তারা কী করছে। প্রথমত, সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। এরপরও না হলে চিকিৎসা খরচ বন্ধ করেন বা কমিয়ে দেন। তখনও যদি সংকুলান না হয়, তাহলে খাবার খরচ কমিয়ে দেন। এক্ষেত্রে পরিবারে এক বেলা ৫টি ডিম লাগলে দুটি দিয়েই পাঁচজন খেয়ে নেন। তিন বেলার পরিবর্তে এক বেলা পেট পুরে খেয়ে দিন-রাত পার করেন। এসব করার কারণে একদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে কম খাওয়ার কারণে অপুষ্টি বাড়ছে। সূত্র : যুগান্তর

শেয়ার করুন