ঋণের সুদ বাবদ গত আট মাসে ৫৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে বরাদ্দের ৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ খরচ হয়েছে। যার সিংহভাগই খরচ হয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। কিন্তু এই অর্থের বেশিরভাগই সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে শঙ্কার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, চলতি বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের বেশি খরচ হয়েছে জাতীয় সঞ্চয় পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ। চলতি বছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা অতিক্রম করে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি অর্থবছরে প্রকৃত ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ অর্থ বরাদ্দকৃত পরিমাণ থেকে বেশি হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রকৃত ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের ঋণের সুদ বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে ৮ শতাংশের ওপর উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে সঞ্চয়পত্রে তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এক প্রতিবেদনে এমন পরামর্শ উঠে এসেছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ না কমে আরও বাড়ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ঋণ বাড়ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকবহির্ভূত খাতে কমছে। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চলমান চাপ বিবেচনায় ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত খাতে বাড়ানো দরকার। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ ছিল ৩৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে ঋণ কমে যায় ৩ হাজার ৬৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ঋণ না কমে আরও বেড়েছে, মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে নিট ৫০ হাজার ৭১১ কোটি টাকা নিয়েছে। জানুয়ারির তুলনায় ঋণ বেড়েছে আরও ১৬ হাজার ১২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৪৮ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চারটি বৈদেশিক ধাক্কার কারণে মোট সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে ২৭ শতাংশ। এর পেছনের কারণগুলো হলো মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, সাম্প্রতিক লাইবর রেট বেড়ে যাওয়া, মার্কিন ট্রেজারির সুদের হার বৃদ্ধি এবং ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধি। ফলে আগামী বাজেটে মোট সুদ পরিশোধের পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঘিরে সৃষ্ট চাপ ও শঙ্কা শিগগিরই কাটবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য ঋণের সুদ এমনিতেই বেড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আগামীতে সুদ কম হয় এমন অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। চলতি বাজেটে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ফলে অতিরিক্ত সুদ প্রদান করতে হচ্ছে সরকারকে।
সাবেক অর্থ সচিব মাহমুদ আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিবছর সুদ পরিশোধের পরিমাণ সীমারেখার মধ্যে রাখতে হবে। কারণ চলতি বাজেটের সুদ পরিশোধের পরিমাণ মোট বাজেটের প্রায় ২৯ শতাংশ। এবারে বাজেটে এ পরিমাণটিই সর্বোচ্চ। তবু দেখা যাবে সুদ পরিশোধে বাজেটে বরাদ্দের থেকে এর প্রকৃত পরিমাণ বেড়ে যায়। এ বিশাল আকারের সুদ পরিশোধের পরিমাণ কমাতে না পারলে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে। এজন্যই রাজস্ব বাড়াতে হবে। সরকার যাতে বেশি ঋণ নিতে না পারে। প্রতিবছর দেখা যায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, এর লাগাম টানতে হবে, তা না হলে বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, এখনও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেশি আসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি থেকে। সঞ্চয়পত্রগুলোর ব্যাংকের থেকে সুদের হার বেশি। তবে সঞ্চয়পত্রের ক্রেতারা বয়স্ক মানুষ। সরকারের সঞ্চয়পত্রের ঋণ অনেককে অতিরিক্ত সুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
সাথী / পরিচয়