নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মধ্যবিত্ত আয়ে নিম্নবিত্ত জীবন

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২ | ০৫:১১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২২ | ০৫:১১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
মধ্যবিত্ত আয়ে নিম্নবিত্ত জীবন

টাকার অংকে ৫০ হাজার কম নয়। ৫০ হাজার মানে অর্ধ লক্ষ টাকা। একসময় লাখোপতি মানে বিরাট ব্যাপার ছিল; কিন্তু এখন সেই অর্ধ লক্ষ টাকায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাস চলে না। সংসারে টানাটানি। হাত পড়ছে সঞ্চয়ে; কিন্তু যার কোনো সঞ্চয় নেই, তার কী উপায়?

সামনে আরও খারাপ দিন- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলছেন, কম খরচ করতে। যতটা সম্ভব সঞ্চয় করতে। এমনকি তিনি বৈশ্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে দুর্ভিক্ষেরও ইঙ্গিত দিচ্ছেন। গণমাধ্যমের খবরও বলছে, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশেও হয়তো খাদ্যসংকট আসন্ন। এখন প্রশ্ন হলো-

. সত্যিই কি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে?

. বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ পরিস্থিতি কি ঝুঁকিতে আছে?

. খাদ্য উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকলে মৌলিক খাদ্যপণ্যগুলোও কি সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগাল ছাড়িয়ে যাবে?

. কেন ৫০ হাজার টাকায়ও একটি পরিবার চলতে পারছে না?

. প্রধানমন্ত্রী সঞ্চয় করতে বলছেন কাদের? অধিকাংশ মানুষের তো সমগ্র আয়ই খরচ হয়ে যাচ্ছে, তিনি কী সঞ্চয় করবেন? তা হলে সঞ্চয় করবেন কারা? যাদের বাড়তি আয় আছে? তাদের সেই সঞ্চয় কি সংকটকালে সঞ্চয়হীন মানুষের কোনো উপকারে আসবে?

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক কালের কণ্ঠ মাসে ৫০ হাজার টাকা উপার্জনকারী একটি পরিবারের খরচের হিসাব দিয়ে দেখিয়েছে, বাসা ভাড়া, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট ও ডিশ বিল, গৃহকর্মীর বেতন, সন্তানের পড়ালেখা, ওষুধ, অফিস যাতায়াতের পেছনে যা খরচ হয়, তার পর ৬ সদস্যের একটি পরিবারে পুরো মাসের বাজারের জন্য ১৫ হাজার টাকাও অবশিষ্ট থাকে না; কিন্তু এই টাকা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধের মতো খুব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

অবসরে বিনোদন, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এবং কোথাও ঘুরতে যাওয়া এমনকি সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াটা এখন রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। অথচ ৫০ হাজার টাকায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশ ভালোভাবে বেঁচে থাকার কথা ছিল। অন্তত এক দশক আগেও মাসে ৫০ হাজার টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে মধ্যবিত্ত বলা হতো। অথচ সেই উপার্জনেও এখন মানুষকে যাপন করতে হচ্ছে নিম্নবিত্তের জীবন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে; করোনার অতিমারীতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতিও যেখানে বিপর্যস্ত, সেই তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল বা অন্তত খাদ্যসংকট যে দেখা দেয়নি, সেটি নিশ্চয়ই স্বস্তির; কিন্তু সেই স্বস্তি যে টেকসই হচ্ছে না, সেটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও স্পষ্ট।

সবশেষ গত ৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে আগামী বছর সারা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত দুর্যোগময় হতে পারে। এমনকি বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষও দেখা দেবে- এমন শঙ্কা সকলের মনে আছে। এ অবস্থায় সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, যার যেখানে যতটুকু জমি বা জলাধার আছে, সেখানে কিছু না কিছু উৎপাদন করুন।

প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন- যার যতটুকু সম্ভব সঞ্চয় করুন; কিন্তু সমস্যা হলো আয়ের পুরোটাই যখন চলে যায় জীবন-যাপনের পেছনে, সেখানে সঞ্চয় তো দূরে থাক, উল্টো অনেকে সঞ্চয়ই ভেঙে ফেলছেন। ১৩ অক্টোবর ডেইলি স্টারের একটি খবরে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাতে অনেকে নতুন করে সঞ্চয় করতেও পারছেন না।

একটি খবরে এক ব্যাংক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়- এখন সুদহার এত কম যে, মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চায় না। দেশে অন্য কোথাও বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা রাখে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করত; কিন্তু সেটাও এখন জটিল করে ফেলা হয়েছে।

মানুষের আয় কমেছে; কিন্তু বিপরীতে বেড়েছে চাল-তেল-ডিম ও মাছ-মাংসের দাম। এটাকে বলে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। যদিও সরকারের তরফে বরাবরই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়, কিন্তু সেই আয় বৃদ্ধি হওয়া মানুষের সংখ্যা কত এবং কত আয় বৃদ্ধির বিপরীতে কত টাকা ব্যয় বেড়েছে, তার সঠিক ও আনবায়াসড (পক্ষপাতহীন) পরিসংখ্যান নেই। ধরা যাক একজন লোকের আয় দুই হাজার টাকা বেড়েছে; কিন্তু যদি তার চেয়ে ব্যয় বাড়ে, তা হলে দিনশেষে ওই আয় বৃদ্ধি কোনো অর্থ বহন করে না।

সে কারণে নিত্যপণ্যের দাম প্রান্তিক মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে রাখাই হচ্ছে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য; কিন্তু আমাদের দেশের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশে একেবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যে দাম, তা যথেষ্ট বেশি এবং এই খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশ দুর্বল। আমাদের বাজারব্যবস্থা এতই অদ্ভুত যে, যে কেউ যে কোনো সময় যে কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন এবং একবার বাড়লে সেটি আর কমতে চায় না।

যেসব অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়, সেই পরিস্থিতির উন্নতি হলেও সাধারণত দাম কমে না। আবার এই যে ব্যবসায়ীরা চাইলেই দাম বাড়াতে পারেন, সেজন্য তাদের সাধারণত কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। এরকম ব্যবসায়ীবান্ধব বাজার ব্যবস্থায় ৫০ হাজার টাকায়ও যে একটি পরিবার চলতে পারবে না, মধ্যবিত্ত আয়েও যে মানুষকে নিম্নবিত্তের জীবন-যাপন করতে হবে; সেটিই স্বাভাবিক।

তবে এতকিছুর পরও বাংলাদেশের মানুষের টিকে থাকার নিজস্ব কিছু কৌশল আছে। যেসব কৌশল ও শক্তি বারবার সংকটে তাকে টিকিয়ে রাখে। সেই শক্তির বিরাট উৎস এই দেশের মাটি ও জলবায়ু এবং কৃষকের পরিশ্রমী মানসিকতা। রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্ব পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু যেহেতু কৃষিউপযোগী এবং এখানের মানুষ যেহেতু পরিশ্রমী; ফলে দেশের মানুষ অন্তত ভাত ও সবজি খেয়ে টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয়।

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন খরা-লবণ ও জলসহিষ্ণু ফসলের জাত। বিগত বছরগুলোয় শহরাঞ্চলে ছাদকৃষি যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, তা বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্যই শিক্ষণীয় এবং ঈর্ষার। শহরাঞ্চলের অনেক সচ্ছল মানুষও এখন নিজেদের ছাদবাগানের কৃষি দিয়েই নিজেদের সবজির চাহিদা মেটান। তা ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতেও দেশে যে বিপ্লব হয়েছে, তা অভূতপূর্ব।

কৃষিজমির পরিমাণ কমার পাশাপাশি নানাবিধ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও প্রতিবছরই যে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে তা দেখা যাচ্ছে সরকারের সবশেষ (২০২২) অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। সমীক্ষা বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আউশের উৎপাদন হয়েছে ৩৪.৮৪ লাখ টন, যা আগের বছরের তুলনায় ২ লাখ টন বেশি। আমনের উৎপাদন হয়েছে ১৫০.৪৭ টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৬ লাখ টন বেশি। বোরো, গম ও ভুট্টার উৎপাদনও প্রতিবছরই বাড়ছে। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সমন্বিত হিসাব অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪৪৩.৫৬ লাখ টন।

২০২১-২২ অর্থবছরে মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ পাওয়া গেছে ১৩.৮ লাখ টন, যা আগের ৭ বছরের চেয়ে বেশি। এই অর্থবছরে চাষকৃত মাছের উৎপাদন হয়েছে ৩৯.৬৪ টন, যা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই বাড়ছে। তবে সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিম, মাংস ও দুধের উৎপাদন গত অর্থবছরের চেয়ে কমেছে (অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২, পৃষ্ঠা ৯৭)। বলা হচ্ছে- এই তিন খাতে উৎপাদন কমার পেছনে করোনার প্রভাব রয়েছে।

সুতরাং মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাত যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন হবে এবং কৃষির সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা গেলে দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হবে না, সে আশাবাদ ব্যক্ত করাই যায়। সেজন্য সেচ-সুবিধা সম্প্রসারণ ও সেচ যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, লক্ষ্যভিত্তিক কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি উপকরণের দাম সহনীয় রাখা, সময়মতো কৃষকের কাছে বীজ ও সার পৌঁছানো এবং সর্বোপরি বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক রাখতে হবে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ এই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই। এখানে ব্যর্থ হলে খাদ্যসংকট ঠেকানো কঠিন হবে। সূএ : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন