নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতকে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট ও বাংলাদেশের প্রাপ্তি

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩ | ১১:৪২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১২ মে ২০২৩ | ১১:৪২ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ভারতকে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট ও বাংলাদেশের প্রাপ্তি

অবশেষে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হলো৷ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নিয়মিতভাবে পণ্য আনা-নেয়ার দ্বার পুরোপুরি খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ৷ এতে করে বাণিজ্যিকভাবে এই দুটি বন্দর ব্যবহার করতে পারবে ভারত৷ এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে একটি স্থায়ী আদেশ জারি করেছে৷ ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে এ দুই বন্দর ব্যবহার বিষয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষর হয় যার আওতায় ২০২০ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের এ দুটি বন্দর ব্যবহার করে কয়েকটি পরীক্ষামূলক চালান গিয়েছে৷ পরীক্ষামূলকভাবে বন্দর ব্যবহারের পর এবার নিয়মিতভিত্তিতে তা করার সুযোগ দেয়া হলো৷ এই সুবিধার আওতায় মূলত ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে বাংলাদেশকে নির্ধারিত মাশুল প্রদান করে৷ অনেকের মতে, এর মধ্য দিয়ে নিয়মিত বা স্থায়ী ভিত্তিতে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়া হলো ভারতকে৷

বস্তুত, ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার বিষয়টি বেশ পুরোনো এবং বাংলাদেশের ভেতরে এ নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক অনেক বছরের৷ অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে অনেক কথা-বার্তা হয়েছে৷ তবে ২০১০ সাল থেকে এটি অনেক বড় আকারে সামনে আসে ও নানাধরণের বিতর্ক তৈরি হয়৷ সরকার সে সময় বিশেষজ্ঞ-আমলা সমন্বয়ে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠন করে৷ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন দিক পরযালোচনা করে কমিটির প্রতিবেদনে ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করা হয়, ট্রানজিট নয়৷ তবে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি৷ সে সময় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ফি বা মাশুল নিয়েও বির্তক দেখা দেয়৷ নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ কোনো মাশুল না নেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন৷ তবে ভারতের প্রত্যাশা অনুসারে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হতে থাকে ৷

 

বহুমাত্রিক ট্রান্সশিপমেন্ট

ভারতকে বাংলাদেশ মূলত মাল্টিমোডাল বা বহুমাত্রিক ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিতে শুরু করেছে ২০১০ সালে৷ দুদেশের মধ্যকার নৌ প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে এটি শুরু হয়৷ প্রথমে কলকাতা থেকে আশগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, তারপর আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া-আগরতলা পর্যন্ত সড়কপথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে ৷ এরপর ২০১৬ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত ব্যবস্থা হিসেবে চালু করা হয়৷ তবে গত সাত বছরে অল্প কিছু চালান গিয়েছে এই ব্যবস্থায়৷ আশুগঞ্জ নৌবন্দরের অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পথে তেমন আগ্রহী নন৷ আবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে৷ ১৯৬৫ সালের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া আটটি রেলপথের মধ্যে পাঁচটি ইতিমধ্যে চালু হয়েছে৷ বাকি তিনটি নতুনভাবে চালু করার জন্য কাজ চলছে৷ এতে করে যাত্রীর পাশাপাশি পণ্যপরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে যা ট্রানজিটের পরিধি বাড়াবে৷

উল্লেখ্য, সাধারণত প্রথম দেশ দ্বিতীয় দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে যখন তৃতীয় দেশের জন্য পণ্য বহন করে নিয়ে যায়, তখন তা প্রথম দেশটির জন্য দ্বিতীয় দেশ থেকে পাওয়া ট্রানজিট সুবিধা বিবেচিত হয়৷ বাংলাদেশি ট্রাক ভারত হয়ে নেপালে গেলে তা হবে বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের ট্রানজিট সুবিধা৷ এ বিবেচনায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় সরাসরি সড়কপথে কিংবা ভারতের মেঘালয়ে নৌপথে পণ্য পরিবহনকেও এক ধরণের ট্রানজিট সুবিধা হিসেবে ধরা যায় যদিও এ নিয়ে দ্বিমত আছে৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও)-র নীতি-বিধি অনুসারে তৃতীয় দেশে পণ্য নিয়ে প্রথম দেশকে দ্বিতীয় দেশ ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাধ্য হলেও একই দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানের জন্য এই সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য নয়৷ তবে দেশ দুটি পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এই ট্রানজিট চালু করলে তাতে কোনো বাধা নেই৷

আবার পণ্যবাহী একটি যানবহন থেকে পণ্য আরেকটি যানে স্থানান্তর করে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলা হয়৷ যেমন: ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরে ঢুকে পণ্য খালাস করল৷ সেই পণ্য বাংলাদেশি ট্রাকে করে আবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেষা আখাউড়া স্থলবন্দর গিয়ে নামিয়ে দেয়া হলো যা আবার ভারতীয় ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো৷ এই পুরো প্রক্রিয়াটি ট্রান্সশিপমেন্ট৷ এখন ভারতের প্রধান ভূখণ্ড থেকে জাহাজে আসা পণ্যগুলো বাংলাদেশি যানবাহনে তুলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতরে আটটি রুট দিয়ে চারটি স্থলবন্দর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নেওয়ার কাজটি হলো মূলত ট্রান্সশিপমেন্ট৷ একইভাবে ঐ রাজ্যগুলো থেকেও পণ্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে আবার ভারতে নেওয়া যাবে৷

দেখা যাচ্ছে, এ ব্যবস্থায় ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট কিছুটা মিশ্রিত হয়ে গেছে৷ ভবিষ্যতে কখনো যদি তৃতীয় দেশ (যেমন: সিঙ্গাপুর) থেকে আমদানিকৃত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে খালাস করে ত্রিপুরা বা মেঘালয়ে নেয়া হয়, তাহলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক ট্রানজিট ব্যবস্থায় রূপ নেবে৷ তখন একটি বড় ধরণের জটিলতা দেখা দেবে পণ্যের শুল্কায়ন নিয়ে৷ কেননা, পণ্য আমদানি করেছে ভারত৷ তাই শুল্কায়ন ভারতেরই করার কথা৷ চট্টগ্রাম বন্দরে শুধু বাংলাদেশের আমদানিকৃত পণ্যের শুল্কায়ন হয়৷ সেক্ষেত্রে শুধু ট্রান্সশিপমেন্ট বা পণ্য সরাসরি খালাস করে ভারতীয় সীমান্তে নিয়ে শুল্কায়ন করার ব্যবস্থাও হতে পারে৷

নেপাল ও ভুটান

নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল৷ কিন্তু তা কাজ করেনি নানা প্রতিবন্ধকতায়৷ এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে স্থলবন্দর ও ট্রানজিট রুটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে ২০১০ সালের পর৷ বর্তমানে নেপাল ও ভুটানের ট্রাক ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ সীমান্ত পরযন্ত পণ্য বহণ করতে পারে৷ কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করে মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর পরযন্ত যাতায়াত করতে পারে না৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশি ট্রাকে পণ্য নিয়ে ভারতীয় সীমান্তে গিয়ে তা খালাস করা হয়৷ তারপর আবার ভারতীয়, নেপালি বা ভুটানি ট্রাক তা তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যায়৷ এই ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা অনেকদিন থেকেই চালু আছে৷ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পদ্ধতি (এসওপি) তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশ৷

অবশ্য ভারত গতবছর বাংলাদেশকে বিনা মাশুলে তাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছে৷ এতে করে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক এখন ভারতের নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ও পথ হয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারবে৷ তবে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের জন্য হয়তো আরেকটু সুবিধা হতে পারে৷ ভুটান অবশ্য এখনো এই চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেনি৷

প্রাপ্তির খাতা

এখন পর্যন্ত ভারতকে দেয়া ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়টি সেভাবে দৃশ্যমান নয়৷ সে কারণেই একটা ধারণা বেশ জোরাল যে প্রায় একতরফাভাবে এসব সুবিধা দেয়া হয়েছে৷ ভারতের সাথে বিদ্যমান বড় বাণিজ্য ঘাটতি (১,১৭০ কোটি ডলার), তিস্তাসহ ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি বন্টন বিষয়ে সুরাহা না হওয়া, সীমান্তে হত্যা শূন্যতে নামাতে না পারাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সাথে সন্তোষজনক সমঝোতা না হওয়ায় ট্রানজিট সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীও বেড়েছে৷

পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এই ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য-পরিবহন তথা লজিস্টিক ব্যবসা সম্প্রসারণের একটা সুযোগও তৈরি হয়েছে৷ কারণ, ট্রান্সশিপমেন্টের ট্রাক বা যানবাহন বাংলাদেশের৷ অবশ্য এসব পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট মাশুল বাবদ যা পাওয়া যাচ্ছে বা যাবে, তা বড় অংকের কিছু নয়৷ তাছাড়া দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থার খানিক উন্নতি হয়েছে যা আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পথের বাঁধা অনেকটা কমিয়েছে৷ তবে আঞ্চলিক সম্পৃকক্তাকে অর্থবহ করার জন্য ভারতের দিক থেকে আরো ইতিবাচক ও সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন৷ জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে-র সৌজন্যে

সাথী/পরিচয়

শেয়ার করুন