নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজধানীর বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

লেলিহান শিখায় স্বপ্ন পুড়ে নিঃশেষ

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০৪:১১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০৪:১১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
লেলিহান শিখায় স্বপ্ন পুড়ে নিঃশেষ

অগ্নিকাণ্ড রাজধানীর বঙ্গবাজারে মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুনে জ্বলছে শত শত দোকান। ঈদের আগে সব হারিয়ে দিশেহারা ব্যবসায়ীরা -সংগৃহীত

রাজধানীর বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনে পুড়ে গেছে চারটি মার্কেট নিয়ে তৈরি বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স। কাঠ ও টিনের তৈরি তিনতলা এই মার্কেটে ছিল প্রায় ৫ হাজার দোকান, গোডাউন ও কারখানা। কমবেশি পুড়েছে আশপাশের আরও পাঁচটি মার্কেটের কয়েকশ দোকান। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পায়নি পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকও। একে একে রাজধানীর প্রায় সবগুলো ফায়ার স্টেশনের দমকল বাহিনীর কর্মীরা এসে যুক্ত হয় অগ্নিনির্বাপণে। ধাপে ধাপে যোগ দিয়েছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের দমকলকর্মীরাও। সবমিলে অর্ধশতাধিক ইউনিট আগুন নেভাতে নিরন্তর চেষ্টা চালায়। তবুও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছিল না।

এ অবস্থায় যোগ দেন সেনা, নৌ, বিমান, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। ব্যবহার করা হয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। তাদের প্রাণান্তকর ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত মালামাল তুলে দোকান সাজিয়ে বসেছিলেন এসব ব্যবসায়ী। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ধারণা, সব মিলিয়ে এ আগুনে হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখায় তাদের স্বপ্ন পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৫০ হাজার কর্মীর পরিবার। এই বিপুলসংখ্যক কর্মীর কাজ হারানোর শঙ্কা আছে। মঙ্গলবার ভোরের এই আগুন মধ্যরাত পর্যন্ত জ্বলছিল। এদিকে সার্বক্ষণিকভাবে পুরো পরিস্থিতি মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা জানান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিতর্কিত ‘গায়েবি’ মার্কেট থেকে ঘটনার সূত্রপাত। আগুনের সঙ্গে ছিল বাতাস। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। টিন ও কাঠের তৈরি তিনতলা বঙ্গবাজার মার্কেটটি ভেঙে রাস্তার পশ্চিম পাশের মার্কেটগুলোর সামনে পড়ে। তখন এসব মার্কেটেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সব হারানো ব্যবসায়ীদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বঙ্গবাজারের আশপাশের পরিবেশ। তাদের একজন অপরজনকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বজনকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করেন এখন কী হবে। আমরা তো পথের ভিখারি হয়ে গেলাম। আমাদের সব শেষ। এখন কীভাবে ঋণ পরিশোধ করব। টাকা আসবে কোথা থেকে-এ ধরনের কথা বলে কাঁদতে থাকেন। কোটি কোটি টাকার মালামাল হারানোর শোক সইতে না পেরে একাধিক ব্যবসায়ী ঘটনাস্থলেই সংজ্ঞা হারান। তারা বলতে থাকেন করোনার ধকল কাটিয়ে মাত্র ব্যবসা গুছিয়ে এনেছি, এমন সময় এ আঘাত। এটা সইব কী করে। এদের অনেকেই ধার করে, সুদের ওপরও টাকা এনে বিনিয়োগ করেছেন বলে মন্তব্য করেন এক ব্যবসায়ীর স্বজন। তাদের আহাজারি উদ্ধারকর্মী ও উপস্থিত জনতাকেও আবেগপ্রবণ করে তোলে। তাদের মধ্যে অনেককেই অনাত্মীয় ব্যবসায়ীদের সান্ত্বনা দিতে দেখা যায়। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির খবর মেলেনি, তবে অন্তত ৪০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ক্ষয়ক্ষতির ধকল সামাল দিতে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের কেউ কেউ বলেন, সরকারি সহায়তা না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। এমন সকাল তারা কেউ দেখতে চাননি বলে হাহাকার করতে থাকেন।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর লাগোয়া মার্কেটগুলোর আগুন নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বাহিনীটির সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। তাদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে ফায়ার কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭-৮ জন ফায়ারকর্মী। দীর্ঘসময়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় একপর্যায়ে আগুনের শিখা ছুঁয়ে ফেলে পুলিশ সদর দপ্তর। সেখানে অবস্থিত পুলিশের ব্যারাকেও আগুন লাগে। সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করাসহ সবকিছু খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি।

এর আগেও একাধিকবার বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছে। কিন্তু এরপরও সে ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, ফায়ার সার্ভিসকর্মী ও দোকান কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে যে কোনো সময় বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত। ‘গায়েবি মার্কেট’ হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ সুপার মার্কেটের এক কোনায় আগুন ধরার পরই তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চার মার্কেটের সমন্বয়ে তৈরি বঙ্গ কমপ্লেক্সে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

লেলিহান শিখা কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উড়তে থাকে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে যায় আকাশ। একের পর এক ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট যোগ দিয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। ফলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে আগুন নেভাতে নেওয়া হয় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। যোগ দেন সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। স্কাউট, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাও যোগ দেন।

উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি চলাচল ও ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার সুবিধার জন্য আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টার আগেই বঙ্গ কমপ্লেক্সের আওতায় থাকা গুলিস্তান মার্কেট, মহানগর মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট ও আদর্শ মার্কেট সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরও এই মার্কেটের ধ্বংসস্তূপে আগুন জ্বলছিল। সকাল ৯টার পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের বাংলাদেশ সুপার মার্কেট, বঙ্গবাজার, এনএসকো টাওয়ার, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটে। তবে এসব মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে ব্যবসায়ীরা তাদের অনেক মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কাপড় সরাতেও ঘটেছে বিপত্তি।

কোনোভাবে রক্ষা করা কাপড়ও চুরি হয়ে গেছে। অনেকেই ভেতর থেকে কাপড় এনে রাখেন ফ্লাইওভারের নিচে। সেখান থেকে আবার ছুটে যান ভেতর থেকে কাপড় আনতে। কিন্তু এসে দেখেন আগের রেখে যাওয়া কাপড় নেই। কেউ নিয়ে গেছেন। এ দৃশ্য দেখে আকাশের দিকে দুহাত তুলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন এক ব্যবসায়ী। শেষ সম্বলটুকু আগুনের কাছ থেকে কেড়ে আনতে পারলেও অসাধু মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করতে না পারার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।

যেভাবে ছড়ায় আগুন : টিন ও কাঠের তৈরি তিনতলা বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সে আগুন লাগার পর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আগুনে পোড়া মার্কেটের কাঠামো ভেঙে পাশের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের পাশে পড়ে। সেখানে ফুটপাতে স্তূপ করে রাখা ছিল গার্মেন্ট পণ্য। মুহূর্তেই সেগুলোয় আগুন ধরে যায়। একপর্যায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গ ইসলামিয়া পাকা মার্কেটে।

এই মার্কেটের হিমেল গার্মেন্টের মালিকের ভাই মাহফুজুর রহমান জানান, ভোরে আগুন লাগার পর এলাকার সুযোগসন্ধানী লোকজন ও মাদকাসক্তরা দোকানে দোকানে ঢুকে ক্যাশবাক্স, নগদ টাকা ও মালামাল লুট করেছে। সোমবার দুপুরের পর ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পণ্য বিক্রির টাকা দোকানেই রেখে গিয়েছিলেন।

তাদের একজন আহাদ। তিনি দোকানে রেখে গিয়েছিলেন ১৮ লাখ টাকা। টাকা উদ্ধার করতে দোকানে যাওয়ার জন্য তিনি আগুনের মধ্যেই ঝাঁপ দেন। কিন্তু এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। টাকা পাননি। সাগর নামের এক ব্যবসায়ী ক্যাশবাক্সে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা টাকা খুঁজছিলেন। ব্যবসায়ীরা জানান, মালামালের সঙ্গে অনেকের টাকাও পুড়ে গেছে। আবার চুরিও হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কেউ কেউ।

বঙ্গবাজারের অভিযাত্রী শাড়ি বিতানের মালিক এএসএম তছলিম উদ্দিন আহাজারি করে জানান, তার অন্তত আড়াই কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষ্যে তার দোকানে টাঙ্গাইল ও ভারতীয় শাড়ি তোলা হয়েছিল। ২-৩ কোটি টাকার মাল তোলা হয়েছিল-এমন অনেক দোকানের সব নিঃশেষ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

মো. কামাল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, যারা সবচেয়ে ছোট ব্যবসায়ী, তাদের দোকানেও ২০-২২ লাখ টাকার মাল তোলা হয়েছিল। এসব ব্যবসায়ী এখন দিশেহারা। মহানগর মার্কেটের তাসনিম গার্মেন্টের মালিক মো. আশরাফ বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষ্যে আমি ২০ লাখ টাকার বাড়তি মাল তুলেছিলাম। কিছুই সরাতে পারিনি, সব পুড়ে ছাই। এখন সরকারি সহায়তা না পেলে রাস্তায় নামতে হবে।

বেছে নিতে হবে আত্মহত্যার পথ।’ হিমেল নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, ফায়ার সার্ভিসের পাশেই আগুন ধরেছে। এখানে পানিরও সংকট নেই। তারপরও ২০ মিনিট পর আগুন নেভানোর কাজ শুরু করার বিষয়টি রহস্যজনক। তাছাড়া ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে যতটা তৎপর ছিলেন, এর চেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তর রক্ষায়। সকাল থেকেই ফায়ার সার্ভিসের অনেক ইউনিট মার্কেটের আগুনে পানি না দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ভবন ও আশপাশে বিরামহীন পানি মেরেছে।

প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং ও সমন্বয় : আগুন নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সার্বিক খোঁজখবর নেন।

প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের সঙ্গে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী যোগ দেয়। তবে তাদের পানি সংকটে পড়তে হয়েছে। পানি সংকটের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতেও বেগ পেতে হয়েছে। ওই অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে পানি নেওয়া হয়। দীর্ঘ পাইপে পানি নেওয়ার কারণে চাপ না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটছিল। অন্যদিকে হাতিরঝিল থেকে পানি নেয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। আগুন নেভাতে কয়েক দফায় হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে পানি নেওয়া হয়েছে।

কাজ হারানোর শঙ্কা : ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে অন্তত ৫০ হাজার দোকান কর্মচারী কাজ হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। বঙ্গ মার্কেটের তাসনিম গার্মেন্টের কর্মী রুবেল জানান, ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিয়ে পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কেনার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন ধূসর। শুধু রুবেল নয়, তার মতো হাজার হাজার দোকানকর্মীর একই অবস্থা। এই আগুনে পুড়ে গেছে শত শত পরিবারের স্বপ্ন।

সাবধান হয়নি বঙ্গবাজার : বঙ্গবাজারে এ আগুনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও এই মার্কেট ঘিরে ছোট-বড় চারটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে ১৯৯৫ সালে। তখনো এভাবে পুড়ে ছাই হয়েছিল পুরো মার্কেট। এর পরেও শিক্ষা নেয়নি ব্যবসায়ীরা। মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ১০ দফায় নোটিশ দিলেও তারা তা আমলে নেয়নি।

৯৯৯ সেবা বন্ধ : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। জরুরি প্রয়োজনে স্থানীয় থানা অথবা ফায়ার সার্ভিস অফিসে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জরুরি এ সেবা ফের চালু করা হয়েছে।

পানির জন্য হাহাকার : বঙ্গবাজার মার্কেটের অবস্থান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের ঠিক বিপরীত পাশে। এ কারণে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার মাত্র ২ মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। কিন্তু পর্যাপ্ত পানির অভাবে অগ্নিনির্বাপণের মূল কাজে বেগ পেতে হয় তাদের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পানির জন্য ফায়ার কর্মীরা দীর্ঘ সময় ধরে এখানে সেখানে ছোটাছুটি করেন।

এই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণে ব্যস্ত একদল মানুষ। এদের উদ্দেশে নারী ব্যবসায়ী চিৎকার করে বলতে থাকেন, আল্লাহরওয়াস্তে আপনারা ভিডিও না করে পানির ব্যবস্থা করেন। আগুন নেভান। আগুনে আমাদের সব পুড়ে যাচ্ছে, আপনারা রক্ষা করেন। পানির সংকটেই আগুন মার্কেটগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে আনা হয় পানি।

মূলত অগ্নিনির্বাপণে এটিই ছিল পানির প্রধান উৎস। এর পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর ও হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নেওয়া হয় পানি। আইজিপি জানান, রাজারবাগ থেকে পাঁচটি ওয়াটার ক্যানন এনে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ শুরু করেন তারা।

পুলিশের ওয়াটার রিজার্ভার থেকে প্রায় দুই লাখ লিটার পানি সাপ্লাই দেওয়া হয়। স্থানীয়রা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর বা পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে দ্রুততম সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হতো। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের জন্য অত্যাধুনিক ভবন নির্মিত হলেও ভবনের বাইরের অংশে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হয়নি।

এমনকি ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরেও ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। পাশেই আছে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল। সেখানেও নেই ফায়ার হাইড্রেন্ট।

আগুন নেভাতে হেলিকপ্টার : রাজধানীর বঙ্গবাজারে লাগা ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন সব বাহিনীর সদস্যরা। এতে যুক্ত হয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। সকাল ৯টার পর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে।

ঢাকার বিভিন্ন উন্মুক্ত উৎস থেকে পানি নিয়ে সেগুলো হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ছিটানো হয়। রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা নাছিমা আক্তার যুগান্তরকে জানান, তিনি অন্তত ১০ বার কয়েকটি হেলিকপ্টারকে হাতিরঝিল থেকে পানি উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন।

শেষ সম্বল রক্ষার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা : বঙ্গবাজারের আগুনে যখন সব পুড়ে ছাই তখন পার্শ্ববর্তী এনেক্সকো মার্কেটের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায়ও লেগে যায় আগুন। ছোটাছুটি করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ঈদ উপলক্ষ্যে আনা পণ্যগুলো রক্ষায় শেষ চেষ্টা করেন তারা। সরেজমিন দেখা গেছে, সকালে ঘুমের মধ্যে আগুনের খবর পেয়ে ব্যবসায়ী ও তাদের স্বজনরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।

উপর থেকে নিচে ফেলা কাপড়ের বস্তাগুলো কাঁধে করে ও ব্যাগে ভরে সরিয়ে নেন। কেউ কেউ ভ্যান ও রিকশা ব্যবহার করেও মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। আশপাশের মার্কেটগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া মালামাল সড়কের উপরে রাখা হয়। এতে এত পরিমাণ পণ্য সড়কে জমে যায়, মালামালের স্তূপ সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ফটক পর্যন্ত চলে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পণ্যগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিতে এবং উৎসুক জনতাকে সরাতে কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা উৎসুক জনতা : বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের অর্ধশতাধিক ইউনিট। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও এতে যোগ দেন।
সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা কাজ করেন। এর মধ্যে বিজিবি ছিল ১৪ প্লাটুন এবং পুলিশের প্রায় দুই হাজার ফোর্স কাজ করে। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দেয় স্কাউট, বিএনসিসি, ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকরা।

কিন্তু এর পরেও আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে বেগ পেতে হয় উৎসুক জনতার কারণে। রাস্তার দুপাশে ছিল হাজারো উৎসুক মানুষের ভিড়। এত বিপুলসংখ্যক জনতার উপস্থিতিতে ফায়ার কর্মীদের কাজে বিঘ্ন ঘটে। অগ্নিনির্বাপণের কাজে ব্যবহৃত ভারী যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উৎসুক জনতাকে সরাতে বহু ধরনের চেষ্টা করেন। তবে তারা ঘুরেফিরে ঘটনাস্থলে আসছিলেন।

এতে উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটে। আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার এটা অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন। তিনি দুপুরে ব্রিফিংয়ে বলেন, আগুন আরও আগেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। তবে উৎসুক জনতা ও পানির সংকটের কারণে দেরি হয়েছে।

কার্যকর জনবলের ঘাটতি : বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণ ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিজিবি, এজিবি (আনসার গার্ড), র‌্যাব, পুলিশের বিপুলসংখ্যক কর্মীর উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু তাদের বিপুল উপস্থিতি অগ্নিনির্বাপণের কোনো কাজে আসেনি। তাদের অনেকেই ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। এছাড়া রেডক্রস, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। কিন্তু পানির অভাবে অগ্নিনির্বাপণে তাদের তেমন কিছুই করার ছিল না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত জনবল সন্নিবেশ করা হলে মূল কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। বঙ্গবাজার ছাড়াও রাজধানীর বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তারপর দুর্ঘটনাস্থল ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সরকারি একাধিক সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শুধু বাঁশি বাজিয়ে দায় সারেন।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে হামলা : বঙ্গবাজার যখন আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, তখন উত্তেজিত জনতা হামলা চালায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের অভ্যর্থনা কক্ষ, কয়েকটি গাড়ি এবং পাশের একটি ভবনের কাচ ভাঙচুর করেন তারা। পুলিশ ও দমকল কর্মীদের মারধর করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আপনাদের জন্যই আমরা জীবন দিচ্ছি। তার পরও কেন ফায়ার সার্ভিসের ওপর এই আঘাত? মঙ্গলবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঘটনাস্থলে ব্রিফিংয়ে তিনি এ প্রশ্ন রাখেন।

মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজার এলাকায় আগুন লাগে। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। এই আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট কাজ করেছে। এছাড়া সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, ওয়াসাসহ অনেক সংস্থা আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে। ইতোমধ্যে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছি। আরেকটু সময় লাগবে সম্পূর্ণ নির্বাপণ করতে। আমাদের প্রতি তলায় প্রতিটি ঘরে-ঘরে বা প্রতিটি রুমে-রুমে গিয়ে নির্বাপণ করতে হবে। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত এবং মর্মাহত এই আগুনের দুর্ঘটনার জন্য। কেন হয়েছে আমরা এখনো জানি না, কীভাবে ঘটেছে তা জানি না। আমরা পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করব আগুন নির্বাপণের পর। তারপর আপনাদের জানানো যাবে।

তিনি আক্ষেপ নিয়ে আরও বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের অফিসার এবং কর্মচারীরা আপনাদের জন্য, মানুষের জন্য জীবন দেয়। গত এক বছরে ১৩ জন ফায়ার ফাইটার শহিদ হয়েছেন, ২৯ জন আহত হয়েছেন এবং আজ আটজন আহত হয়েছেন। কেন বা কারা ফায়ার সার্ভিসের ওপর আঘাত হানল আমার বোধগম্য নয়। কারা করেছে, কেন করেছে? আমি তো আপনাদের জন্যই জীবন দিচ্ছি। আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে বলতে চাই, ফায়ার সার্ভিস সব দুর্যোগে আপনাদের পাশে আছে, সবার আগে আমরা যাই, তার পরও কেন আমাদের ওপর এই আক্রমণ? কেন এই আঘাত ফায়ার সার্ভিসের ওপর?’ হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কতটুকু, তদন্তের পর আমরা সেটা বলতে পারব।’

তদন্ত কমিটি : রাজধানীর বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। এতে বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি ও উপসহকারী পরিচালক মো.বজলুর রশীদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ডিএসসিসি সচিব আকরামুজ্জামানের সই করা এক দপ্তর আদেশে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সচিব আকরামুজ্জামান বলেন, ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্য সচিব করা হয়েছে প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তাকে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন-ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলর (১৩. ১৯ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ড), ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, সম্পত্তি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি এবং পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর)। সূত্র : যুগান্তর

শেয়ার করুন