নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্র-সমর্থিত বিদ্বেষে উত্তরাখণ্ডে মুসলিম নির্মূলীকরণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
রাষ্ট্র-সমর্থিত বিদ্বেষে উত্তরাখণ্ডে মুসলিম নির্মূলীকরণ

গত ১৪ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদি উত্তরাখণ্ডের প্রভাতি কুণ্ডে পূজা করেন। ছবি: এক্স থেকে (সাবেক টুইটার)

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখণ্ডে এখন নজিরবিহীন অস্থিরতা চলছে। এটি ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে মুসলিমদের উচ্ছেদ করতে বিদ্বেষী প্রচারাভিযান এতটা অশুভ গতি পেয়েছে। রাজ্য সরকার নির্বিকারভাবে এই নির্মূলীকরণ সমর্থন করছে। রাজ্যের এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় মনোযোগ এড়িয়ে গেছে। কারণ এ নির্মূলীকরণ অভিযানে খুব বেশি রক্তপাত হয়নি। কিন্তু সেখানে সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। উত্তরাখণ্ড এর আগে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে এমন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রত্যক্ষ করেনি। এর আগে জাতি-বর্ণভিত্তিক উত্তেজনা দেখা গেছে এ রাজ্যে। উত্তরাখণ্ডে সম্ভবত অন্য যে কোনো রাজ্যের তুলনায় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা বেশি, তারা জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। এটি উত্তেজনা ছড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯০-এর দশকে উত্তরপ্রদেশে তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুলায়ম সিং প্রশাসন সরকারি কাজে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সদস্যদের সংরক্ষণ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। এটিকে কেন্দ্র করে সেখানে পৃথক রাজ্যের দাবি জোরালো হয়। মুসলিমরা পৃথক পার্বত্য রাজ্যের দাবিকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছিল।

রাজ্যটির জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলিম। মুসলিম জনসংখ্যাকে উচ্ছেদের জন্য বর্তমান প্রচারণা তিনটি স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- মুসলিমদের উপস্থিতিতে কলুষিত হচ্ছে পাহাড়ি রাজ্যের হিন্দুদের আদিম পবিত্রতার ভিত্তি। দ্বিতীয়টি হলো- এই পবিত্র ভূমিতে হিন্দুদের একচেটিয়া স্বদেশীয়তার দাবি। কথিত মুসলিম বহিরাগতদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে হুমকির সম্মুখীন হিন্দু সম্প্রদায়। তাদের দাবি, দ্রুত ও বিপজ্জনকভাবে রাজ্যের জনসংখ্যা পরিবর্তন হচ্ছে। তৃতীয়টি হলো-মুসলিমদের কথিত অন্তর্নিহিত কুসংস্কার ও জিহাদ- জনসংখ্যা জিহাদ, লাভ জিহাদ, ল্যান্ড জিহাদ, মাজার জিহাদ এবং অতিসম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ব্যবসা জিহাদ। এসব যুক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং সংঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠন দ্বারা জোরালোভাবে প্রচার করা হয়, যা রাজ্যের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। উত্তরাখণ্ডে সংঘের ১৪০০ শাখা রয়েছে এবং আগামী দুই বছরে এ সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা চলছে। সংঘের কর্মীরা প্রচার করেন, তাদের কাজ তাদের অবশ্যই হিন্দু জনগণকে সেই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে- রাজ্যের মুসলিম বাসিন্দারা দেবভূমির পবিত্রতা নষ্ট করছে।

সাম্প্রতিক ঘটনা দুটি ছেলেকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। যারা স্থানীয়দের হাতে নবম শ্রেণির একটি মেয়ের সঙ্গে ধরা পড়েছিল বলে অভিযোগ। একে কেন্দ্র করে লাভ জিহাদের আগুন হাওয়া পায়, যে আগুন আগে থেকেই উত্তরকাশিতে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। তা ছাড়া সরকার কর্তৃক মাজার দখলবিরোধী অভিযানে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ দূষিত হয়। পরিস্থিতি এবার গুরুতর হয়ে ওঠে যখন মুসলিমদের দোকানে ‘দেবভূমি রক্ষা অভিযান’-এর পক্ষ থেকে পোস্টারে লেখা হয়, ‘লাভ জিহাদিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, ২০২৩ সালের ১৫ জুনে মহাপঞ্চায়েত হওয়ার আগেই দোকান খালি করে দেবে, তা না হলে তোমাদের পরিণতি নিয়তির ওপর নির্ভর করবে।’ অনেক মুসলিম পরিবার প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে।

এখানেই শেষ নয়, মুসলিম মালিকানাধীন দোকানগুলোতে কালো রং দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেওয়া হয় এবং তাদের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়। ইঙ্গিত দেওয়া হয়, কথিত দেবভূমিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর কোনো অধিকার নেই। এতে মুসলিমরা একরকম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। আইনগত আবেদনের পর রাজ্যের হাইকোর্ট অবস্থা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেন এবং মহাপঞ্চায়েত আহ্বান নিষিদ্ধ করেন।

পার্বত্য রাজ্যটিতে যে বিষয়টি বিশেষভাবে মুসলিমবিরোধী মনোভাব জাগিয়েছে, তা হলো এর নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি তার ৪৫ বছরের জীবনের ৩৩ বছর আরএসএসের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন। ২০২১ সালে হঠাৎ করে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় তার রাজনৈতিক শক্তি কম ছিল। ২০২২ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে নিজের আসনে যাওয়ার পরও তিনি মুখ্যমন্ত্রী পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় সংঘে তার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। পরে তিনি বিজেপির একজন বিধায়কের খালি আসন থেকে নির্বাচিত হন। তিনি মুসলিমদের বহিরাগত, জিহাদি ও শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ছয় মাস পর ২০২১ সালের ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরিদ্বারে একটি কুখ্যাত ধর্ম সংসদ আয়োজন করা হয়। বক্তারা ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ হত্যা করতে বাড়িতে ‘ধারালো তলোয়ার’ প্রস্তুত রাখার আহ্বান জানান। অন্য এক বক্তা রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নকে মডেল হিসেবে তুলে ধরেন। তারা একটি ‘সাফাই অভিযান’ বা মুসলিম নির্মূলীকরণ অভিযানের আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং নেতারাও শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেবে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যম কুইন্ট পর্যবেক্ষণ করেছে, ২০২১ সালের ধর্ম সংসদে যারা ঘৃণামূলক বক্তৃতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন প্রবোধানন্দ ও দর্শন ভারতী, যারা আজও উত্তরাখণ্ডে অবাধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন এবং সহিংসতা উসকে দিচ্ছেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার বলেন, ‘ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতির বিরতিহীন বিস্তার ঘটছে। আগে সাধারণত নির্বাচনের আগে এসব ঘৃণাসূচক কথাবার্তা শোনা যেত। কিন্তু এখন মিডিয়া জগতের নতুন যে চালচিত্র, তাতে রাজনীতিকরা বুঝতে পেরেছেন যে, একটি রাজ্যে এ ধরনের বক্তব্য দিলে অন্য রাজ্যেও নিজের দলের লোকজনের সুবিধা হবে।’

এনডিটিভি ২০০৯ সালে ‘ভিআইপি হেট স্পিচ’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে। তারা বড় বড় রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপির ঘৃণাসূচক বক্তব্য-বিবৃতির ওপর নজর রাখে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এনডিটিভি জানায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বেশ কয়েকজন শীর্ষ বিজেপি নেতা, যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছেন, তারা এসব সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বিবৃতি দিয়েও সহজে পার পেয়ে গেছেন।

গত ডিসেম্বরে উত্তরাখ- রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন হিন্দু ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করেছেন। এ আইনজীবী বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতে যথেষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার এবং অধিকাংশ সময় এসব প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। প্রতিষ্ঠানের এই বিধান পালন না করার যে প্রবণতা তার ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে। যিনি হিংসা ছড়াচ্ছেন, তাকে যদি আপনি শাস্তি না দেন, তাহলে আইন কীভাবে অপরাধ ঠেকাবে?’

কোন কথা ঘৃণাসূচক আর কোনটি নয়, সে ব্যাপারে ভারতে আইনি ব্যাখ্যা খুব স্পষ্ট নয়। তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কিছু ব্যতিক্রমের কথা আইনে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। যাতে বলা আছে, কোন কথা বলা যাবে না বা লেখা যাবে না। আইনে এমন কথা বা কাজকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে কোনো গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসে আঘাত করা ভারতে দ-নীয় অপরাধ। ঘৃণা ছড়ানোর বিভিন্ন মামলা মাঝেমধ্যেই আদালতে আসে। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতে একটি দ্বিধা কাজ করে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদিত্য ভর্মার মতে, ‘সবচেয়ে বড় উদ্বেগ যেটি, তা হলো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা। তিনি ব্রিটেনের উদাহরণ টানেন, যেখানে কোভিড বিধিনিষেধ ভেঙে পার্টি করার জন্য পুলিশ প্রধানমন্ত্রী জনসনকেও জরিমানা করেছে। কিন্তু ভারতে রাজনৈতিক চাপে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছে, এমন ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। অনেক জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। হয়তো আইনে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে; কিন্তু তার চেয়েও যেটা বড় সমস্যা তা হলো—–যা কালো অক্ষরে আইনে এরই মধ্যে লেখা আছে, সেটাও তো প্রয়োগ হচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতা সমাজে যখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়, তার পরিণতি ভয়াবহ। যখন পরিবেশ পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে, মানুষ যখন চরম ভীতি-উসকানির মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে, তখন সে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন, জীবিকা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। সেটাই কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন