নিউইয়র্ক     রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিভেদের দেয়ালে ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিভেদের দেয়ালে ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাড়ি মার-এ-লাগোতে অভিযান চালিয়ে ১১ হাজারের বেশি সরকারি নথি ও ছবি উদ্ধার করে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। এর মধ্যে কিছু নথি ‘টিএস/এসসিআই’ বলে চিহ্নিত করা।

এর অর্থ হলো- এসব দলিলপত্রে এমন সব তথ্য আছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘নজিরবিহীন গুরুতর ক্ষতির’ কারণ হতে পারে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও গোপন নথি সরানোর অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করা হলে তিনি গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন। তাই এ ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নিতেও শঙ্কিত বিচার বিভাগ। কার্যত ক্ষমতায় না থেকেও ট্রাম্প ক্ষমতাচর্চা করে চলেছেন তার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের রাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদী বিভাজন আরও জোরালো হওয়ার কারণে। আর এর মধ্য দিয়েই ট্রাম্প নিজের ভবিষ্যৎ দেখছেন।

গোপন নথি উদ্ধারের পর ট্রাম্প বলেছেন, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি এবং এসব নথি গোপনীয় বলে যে তকমা ছিল তা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তার কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালে ট্রাম্প ওই নথিগুলোকে গোপনীয় রাখা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তার নির্দেশ ছিল ওভাল অফিস থেকে যেসব নথিপত্র সরানো হবে এবং তার বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হবে সেগুলো ডি-ক্লাসিফাইড নথি অর্থাৎ সরকারিভাবে গোপনীয় নয়। কোন নথিকে গোপনীয় বলে চিহ্নিত করা হবে এবং কোন নথিকে এই শ্রেণিতে রাখা হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র  যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের। একটা নথিকে গোপনীয় রাখা হবে না এমন সিদ্ধান্তের জন্য প্রেসিডেন্টেরই নির্ধারিত কোনো আমলার অনুমোদন লাগবে- এ ধারণা অবাস্তব।’

তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোনো নথিকে গোপন, বা গোপন নয়- এমন ঘোষণা করতে পারেন। তবে ওই নথিগুলোর ক্ষেত্রে ট্রাম্প যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। ট্রাম্পের মুখপাত্র টেলর বুডোউইচ গোয়েন্দা সংস্থার তল্লাশি অভিযানকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্প যেহেতু ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা বিবেচনা করছেন, তাই তাকে ‘রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল’ করার একটি চেষ্টা।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বরে। এ নির্বাচনে ১০০ আসনের সিনেটের ৩৫টি আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। সেই সঙ্গে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনা, বা অভ্যন্তরীণ সামাজিক বিভক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছেন। তাই এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আর এর আগে বর্তমান বাইডেন ও ট্রাম্প একে-অপরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখছেন। এবার উত্তপ্ত বক্তব্যের মাঠ পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্য। সেখানে সিনেটর ও গভর্নর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাইডেন কয়েক দিন আগে এই নির্বাচনী এলাকাতে দেওয়া এক ভাষণে অভিযোগ করেন, ট্রাম্প ও তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি এক ‘চরমপন্থি’ হুমকি।

এর জবাবে গত ৪ সেপ্টেম্বর বাইডেনকে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ট্রাম্প। বক্তৃতায় ট্রাম্প তার উপর আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আসল হুমকি হচ্ছে বামপন্থিরা।’ ভাষণে ট্রাম্প হুমকি দেন, তার বাড়িতে সরকারি অতিগোপন দলিলপত্র পাওয়া যাওয়ার ঘটনার তদন্ত হলে তা এমন প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে যা যুক্তরাষ্ট্রে কখনো দেখা যায়নি। কার্যত এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকেই হুমকি দিলেন ট্রাম্প।

তবে গোপন নথি সরানোর ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে জন এম ডিউচ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করার পর, কর্মকর্তারা আবিষ্কার করেন, তিনি দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিতভাবে একটি অরক্ষিত ব্যক্তিগত কম্পিউটারে অতি গোপনীয় গোয়েন্দা নথি জমা করেছেন। এ ঘটনার পর ডিউচ তার নিরাপত্তা ছাড়পত্র হারান। তবে তার বিরুদ্ধে মামলা করার আগেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাকে ক্ষমা করেছিলেন।

২০০৫ সালে ক্লিনটনের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্যান্ডি বার্গারকে জাতীয় আর্কাইভস থেকে গোপন নথি সরানোর দায়ে ৫০ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়েছিল এবং তিন বছরের জন্য তিনি তার নিরাপত্তা ছাড়পত্র (সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স) হারিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে আরেক সাবেক সিআইএ পরিচালক ডেভিড পেট্রাউসকে গুরুতর নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের জন্য ৪০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল এবং একই সঙ্গে দুই বছর তাকে নজরদারিতে রাখারও রায় দেওয়া হয়েছিল।

তবে নথি সরানোর মতো নিরাপত্তা ঝুঁকির পরও তার বিরুদ্ধে বড় কোনো সাজা না হওয়ার পেছনে রয়েছে বিচার বিভাগের দরকষাকষি। পেট্রাউসের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভয় ছিল- আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি গোপন এজেন্টদের নাম, গোপন অভিযান ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংবেদনশীল সম্পর্কসহ বিভিন্ন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও এ শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বিরত থাকবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ শঙ্কাকে অনেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ব্ল্যাকমেইল’ বলেও অভিহিত করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নীতির মূলে রয়েছে বিভাজনের রাজনীতি। এর মধ্য দিয়েই ক্ষমতা কাঠামো টিকে রয়েছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্ণবাদী বিভাজন কমিয়ে আনার। আরও প্রতিশ্রুতি ছিল- ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবেন। তবে এর কোনোটিই সম্ভব হয়নি। বরং মার্কিন সমাজে বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে।

যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করে। একটি আচরণ নীতি সাদাদের জন্য, একটি কালোদের জন্য। এই দুটি নীতি সহজাতভাবেই পৃথক ও অসম। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের পীড়নমূলক আচরণ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। দেশটিতে পুলিশিংয়ের মারাত্মক বর্ণবাদী বাস্তবতা এবং পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রাণ হারানোর ঘটনার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও শ্বাসরোধকর করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাগুলো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মানবিক আচরণের যোগ্য হিসেবে আমলে নিতে চায় না।

‘শ্বেতাঙ্গদের সেবা ও সুরক্ষা সবার আগে’- এটাই তাদের সামাজিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। যা সামাজিক বিভক্তির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে গত ৭০ বছরের মধ্যে এ বিভক্তির দেয়াল বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন ট্রাম্প ও তার বিভাজনের রাজনীতি, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
পরিচয়/এমউএ

শেয়ার করুন