নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আনন্দবাজারের প্রতিবেদন

ইউক্রেনকে সরিয়ে জি২০-তে ‘সফল’ ভারত, নেপথ্যে কি যুক্তরাষ্ট্র?

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:০৮ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১:১১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ইউক্রেনকে সরিয়ে জি২০-তে ‘সফল’ ভারত, নেপথ্যে কি যুক্তরাষ্ট্র?

নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলনের ফাঁকে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ। ছবি : পিআইবি/এএফপি

বৃষ্টিভেজা নয়াদিল্লির রাজঘাটে গান্ধী স্মারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত রাষ্ট্রপ্রধানরা। বৈঠকের শেষ দিনে ঐক্যের এই ছবিটা ধরা পড়বে কি না, সম্মেলন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেও তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে সংশয় কাটিয়ে ‘এক পথিবী’ এবং ‘এক পরিবারের’ জন্য ‘এক ভবিষ্যৎ’ গড়ার লক্ষ্যে একমত হলো সদস্য দেশগুলো। সাফল্যের ঝুলি যে এভাবে ভরবে, তা বোধ হয় প্রত্যাশিত ছিল না নয়াদিল্লির কাছেও।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে দ্বিমেরুকৃত বিশ্বে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হলো ভারত।

শনিবার বৈঠকের প্রথম দিনেই নয়াদিল্লির আনা ঘোষণাপত্রে সিলমোহর দিয়েছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এই সাফল্যকে ‘ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী’ বলে বর্ণনা করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সার্বিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার খবরটি ঘোষণা করে বলেন, ‘আমি ভালো খবর পেয়েছি।

আমাদের দলের কঠিন পরিশ্রমের ফলে নয়াদিল্লির জি২০ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে।’ সাফল্যের জন্য এই সম্মেলনে ভারতের শেরপা অমিতাভ কান্ত, মন্ত্রী ও অন্য সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান মোদি।

ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সুস্থায়ী ও ভারসাম্যযুক্ত উন্নয়নের বিষয়ে একমত হয়েছে সদস্য দেশগুলো। বহুমুখী ও বৈষম্যহীন বাণিজ্যের পক্ষেও সওয়াল করা হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মোদির পুরনো একটি মন্তব্যই একটু অন্যভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সময় কোনোভাবেই যুদ্ধের সময় নয়।’

জাতিসংঘের সনদকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘কোনো রাষ্ট্র ভূখণ্ড বাড়াতে অন্য দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।’ তবে রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’ নিয়ে যেমন ঘোষণাপত্রে কিছু বলা হয়নি, তেমনই জি৭ গোষ্ঠীগুলোর দাবি মেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাবও আনা হয়নি।

আপাতভাবে ভারতের এই ভারসাম্যের কূটনীতি নির্জোট আন্দোলনের সময়কে মনে করিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কোল্ড ওয়ারের তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। মিল বলতে, তখনকার মতোই আড়াআড়িভাবে দুই ভাগে বিভক্ত গোটা বিশ্ব। এক যুক্তরাষ্ট্র বাদে এই যুদ্ধের কুশীলবেরাও সময়ের ফেরে বদলে গেছে। সূক্ষ্মভাবে হলেও বদল এসেছে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানেও।

২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে হওয়া সপ্তদশ জি২০ বৈঠকের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘অধিকাংশ সদস্য’ ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা করছে। এর পাশাপাশি এ-ও বলা হয়েছিল, এই যুদ্ধ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে ‘অন্য মতও’ রয়েছে।

উল্লেখ্য, এত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ধারাবাহিক চাপ সত্ত্বেও জাতিসংঘসহ কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেনি ভারত। মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিন্ন করেনি। বরং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে গেলেও মস্কোর থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে নয়াদিল্লি। ভারত আগাগোড়াই আলোচনার মাধ্যমে রুশ-ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী এক বছর আগে উজবেকিস্তানে শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) বৈঠকে প্রকাশ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলেছিলেন, ‘এখন যুদ্ধের সময় নয়।’ দিল্লি ঘোষণাপত্রেও প্রায় একই কথার পুনরুচ্চারণ করা হয়েছে।

এবারের জি২০ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তা নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা আসতে শুরু করে দিয়েছে। রাশিয়ার বক্তব্য, এই সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে ‘ভারসাম্যের প্রতিফলনই’ দেখা গেছে। ফ্রান্সের বক্তব্য, বৈঠকের উপসিদ্ধান্তে রাশিয়াকে ‘কোণঠাসা’ করা গেছে।

কিন্তু অনেকেরই মত, আয়োজক দেশ হিসেবে নিজের ভারসাম্যের কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে ভারত। জি২০ বৈঠকেই ভারত থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই এই প্রস্তাব নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রায় সব দেশই এই অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে।

বৈঠক শুরুর আগে থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের একাধিক সিদ্ধান্তের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতযশ দেখছেন অনেকেই। লাদাখের সীমান্ত সংঘাত নিয়ে চীন যেমন ভারতের মাথাব্যথা, তেমনই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ‘আগ্রাসন’ নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে ওয়াশিংটনেরও। তা ছাড়া একাধিক আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়া-চীন বোঝাপড়াকেও কড়া নজরে রাখছে বাইডেনের দেশ। ইতিমধ্যে ২০২৬ সালে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে মেনে নিতে আপত্তি জানিয়েছে চীন। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের মতো শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। ব্রিকসের মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে চীন যাতে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারে, সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

সমুদ্রপথে চীনের আগ্রাসন রুখতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় অক্ষ কোয়াডে যোগ দিয়েছে ভারত। সূত্রের খবর, ২০২৪ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে বিশেষ উপস্থিত থাকতে পারেন কোয়াড গোষ্ঠীর রাষ্ট্রপ্রধানরা। তাই নতুন মেরুকৃত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তো বটেই, অন্যান্য নানা ক্ষেত্রেই বোঝাপড়া বাড়াবে ভারত। এই আপাত নিরপেক্ষতার মধ্যে হয়তো আগেকার নির্জোট আন্দোলনের পশ্চিমা বিরোধিতার ছাপ থাকবে না। বরং ঘরে-বাইরের লড়াইয়ে ভারতের জয়ে হয়তো সক্রিয় ভূমিকা নেবে যুক্তরাষ্ট্র। নয়াদিল্লির জি২০ শীর্ষ সম্মেলন হয়তো তারই ইঙ্গিত দিয়ে রাখল। সূত্র : কালের কন্ঠ

শেয়ার করুন