নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুস্মিতা সাহা ও মেহেরুন নাহার মীম

আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:১১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:১১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা

এবারের পোস্টার নকশা করেছেন আয়েশা সিদ্দিকা ছবি: চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আশির দশক। তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা। শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী সবার প্রচেষ্টায় এ উদ্যোগকে বৃহত্তর স্বার্থের ছায়াতলে নিয়ে আসার পরিকল্পনারও সূত্রপাত তখন। সে ধারাবাহিকতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ আপামর মানুষের অংশগ্রহণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হয়েছে।

এই বছর বাংলা ১৪৩০ সনকে বরণ করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এ স্তবক ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। প্রতিবারের মতো এবারো এক মাস আগে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি পর্বের কাজ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। এবারের শোভাযাত্রার মোটিফ হিসেবে দেখা যাবে ময়ূর, বাঘ, টেপা পুতুল (মা ও শিশু), নীলগাই, হাতি ইত্যাদি। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার আহ্বায়ক শিল্পী নিসার হোসেন, যিনি বর্তমানে ডিন হিসেবে সমস্ত আয়োজন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধান করছেন। অনুষদের শিক্ষক ও দুই বর্ষের শিক্ষার্থীদের সহায়তায় শোভাযাত্রার মূল নান্দনিক অংশ নির্মাণে তত্ত্বাবধান করছেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য।

যা কিছু আমাদের লোকায়ত ধ্যান-ধারণা ও চিত্রধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত, অর্থাৎ আমাদের জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, শুরু থেকে সে বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয় শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে, আয়োজনে। দেয়ালচিত্রে প্রাধান্য পায় আমাদের দেশের বরেণ্য শিল্পীদের লোকজ ঐতিহ্যভিত্তিক মোটিফগুলো। পাশাপাশি থাকে কান্তজির মন্দিরের টেরাকোটা, কালীঘাটের পট, বটতলার ছাপাই ছবি থেকে নানা কাহিনী, কখনো করণকৌশল এবং ছবির বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ সবসময় বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প, শিল্প উপাদানকে সংগ্রহ করে তা উপস্থাপন করার চেষ্টা থাকে এ বর্ষবরণের আয়োজনে।

বাংলার লোকঐতিহ্য, পরম্পরাভিত্তিক চিত্ররীতি, বাংলার সরাচিত্র, পটচিত্র, শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, শখের হাঁড়ি, বাংলা-বিহার-ওড়িশার নানা লোকচিত্র ধারা, মধুবনী চিত্রকলা আর এ সময়ের রিকশা পেইন্টিংসহ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে শোভাযাত্রার মোটিফ নির্বাচন করা হয়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় স্ট্রাকচার বা কাঠামো।

১৯৮৯ সাল বা ১৩৯৬ বঙ্গাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত প্রথম শোভাযাত্রার প্রসঙ্গ ধরেই এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শিল্পী ইমদাদ হোসেন ও ওয়াহিদুল হক (ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম) অন্যান্য শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরামর্শ করে নামকরণ করেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। শুরুতে দুই বা তিনটি কাঠামো তৈরি করা হলেও বর্তমানে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০-১২-তে। এসব কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়ায় ভাস্কর্য নির্মাণের কৌশল প্রাথমিকভাবে জানা থাকা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এখানে শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রার মূল এ নান্দনিক অংশ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত পাখি, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, ফুল, পুতুল, মুখোশ ইত্যাদি সবসময় সংগ্রহ করা এবং তা কাঠামো তৈরির বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলে। আরেকটি বিষয় লক্ষ করার মতো যে এ শোভাযাত্রায় পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ চেষ্টা থাকে।

মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে চারুকলার শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী ছবি আঁকা ও মুখোশ তৈরি, সরাচিত্রসহ নানা নান্দনিক উপকরণ তৈরি ও চিত্রকর্ম বিক্রির আয়োজন করা হয়। নববর্ষ ঘিরে করা শিক্ষার্থীদের এসব কাজ বিক্রি করে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় তা দিয়েই আয়োজিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়া দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে একটি আর্টক্যাম্পও হয়। এখানে অঙ্কিত ছবি বিক্রির অর্থ এ বৈশাখ উদযাপনের জন্য দেয়া হয়।

যুগ যুগ ধরে আমাদের গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের পথনাটক, নৃত্য, যাত্রাপালা অনুষ্ঠানে মুখোশের ব্যবহার হয়ে আসছে। মুখোশ আদিম লোকশিল্প। চৈত্রসংক্রান্তিতে মুখোশ পরে নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ। একটা সময় গ্রামাঞ্চলে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের মুখোশ দেখা যেত। মুখোশ শোভাযাত্রাকে জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলে। সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে এবং উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মূলত বাঘ, পেঁচা, হাতি, আর রাজা-রানীর মুখোশই প্রধান। মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য মুখোশ তৈরি হয় দুভাবে। এক. আগে মাটির ছাঁচ তৈরি করে আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে কয়েকটি স্তর তৈরি করা হয়। দুই. কাগজ কেটে মুখোশ তৈরি এবং তার ওপর রঙ দিয়ে বিভিন্ন নকশা অঙ্কন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসবটি ইউনেস্কোর বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে। ২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায়ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতি একটি দেশের ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের অন্যতম ধারক ও বাহক। চৈত্রসংক্রান্তি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতিকে ধারণ করে অনন্য বিশিষ্টতা লাভ করেছে। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে আয়োজিত চারুকলার এ মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বজনীন উৎসব; যার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয় নববর্ষের শুভ উত্থান। সুস্মিতা সাহা ও মেহেরুন নাহার মীম শিক্ষার্থী, প্রাচ্যকলা বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বণিকবার্তার সৌজন্যে

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন